দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ : গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, ‘হয়রানি করা হচ্ছে’
রাজধানীর হোটেলে আটক রেখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলায় আসামিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত ২৮ মার্চ বনানীর একটি হোটেলকক্ষে ধর্ষণের ঘটনায় গত শনিবার দুই ছাত্রীর একজন বাদী হয়ে বনানী থানায় মামলা করেন। এতে আসামি করা হয় চারজনকে। তাঁরা হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, তাঁদের বন্ধু ও পিকাসো রেস্টুরেন্টের মালিকের ছেলে সাদনান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তাঁর দেহরক্ষী। শেষেরজনের নাম জানা যায়নি।
সাফাতের বাবা দিলদার আহমেদ দাবি করেছেন, তাঁর ছেলেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
পুলিশ কী বলছে
দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় বনানী থানার মামলার ব্যাপারে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (উত্তর) উপকমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম আজ সোমবার বলেন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহজাহানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আসামিদের আটক করার জন্য। একটা অপরাধ ঘটেছে, একটা মামলা হয়েছে। তারা যত প্রভাবশালীই হোক, তারা মামলার আসামি। আর মামলার আসামি ধরার জন্য যা যা করার তাই করা হবে।
ডিসি নাজমুল বলেন, মামলার তদন্তের স্বার্থে আসামিরা কোথায় আছে সেটা বলা যাবে না। তবে আসামিরা শনাক্ত হয়েছে। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। থানা পুলিশ তাদের মতো করে তদন্ত করবে। ডিবি পুলিশও আইন অনুযায়ী আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।
আসামিদের কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে কি না জানতে চাইলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ পালিয়ে গেছে কি না সে রকম কোনো তথ্য নেই। কেউ পালিয়ে যেতে পারবে না। তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযোগ রয়েছে আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল আলম বলেন, ‘আসামি যখন সে তো আসামিই। তার আবার প্রভাবশালী কি? তাকে আমরা গ্রেপ্তার করবই।’
এই ঘটনার বিষয়ে আজ সোমবার সন্ধ্যায় বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল মতিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তার জবাব দেননি তিনি।
সাফাতের বাবা কী বলছেন
এদিকে, দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা একটি উদ্দেশ্যমূলক এবং তার জন্য ছেলের সাবেক স্ত্রীর ওপর দোষ চাপালেন সাফাত আহমেদের বাবা ও আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ। আজ সোমবার সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘একটা মেয়ে কি রেপ হয় নাকি? দেড় মাস পরে মামলা করে নাকি? রেপের মামলা হয় ১২ ঘণ্টার মধ্যে। একটি টিভি চ্যানেলের সংবাদ উপস্থাপিকাকে বিয়ে করেছিল আমার ছেলে।… আসলে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছিল। তারপর তাকে ডিভোর্স দিয়েছে দুই মাস আগে। ডিভোর্স দেবার পরে ওই মেয়েই আসলে হ্যারাস (হয়রানি) করছে। সে মেয়ে এই সব কাজ করাচ্ছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এই হলো আসল ঘটনা।’
ছেলে সাফাত এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে দিলদার আহমেদ জানান, তাঁর ছেলে তো আছেই। পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্তে যেটা হওয়ার সেটা তো হবেই।
মামলা বিলম্বে হওয়ার পেছনে প্রভাব ছিল কি না জানতে চাইলে দিলদার বলেন, ‘এসব ভুয়া কথা। এগুলো হবে কেন? কারণ মামলা না নিলে পুলিশের ওপর একটা প্রভাব পড়বে। যেকোনো লোক থানায় গেলে মামলা নিতে পুলিশ বাধ্য, আমি তো পলিটিক্যাল কোনো নেতা না। একজন ব্যবসায়ী।’
ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী সাফাতের পূর্বপরিচিত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দিলদার আহমেদ বলেন, ‘জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছে। পরিচয় না থাকলে তো দাওয়াত দিত না, আর অনুষ্ঠানে আসত না। সঙ্গে তো আরো বন্ধু-বান্ধব এসেছিল।’
মামলার এজাহার
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আসামিরা মামলার বাদী এবং তাঁর বান্ধবী, বন্ধু শাহরিয়ারকে আটক রাখেন। অস্ত্র দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেন। বাদী ও তাঁর বান্ধবীকে জোর করে ঘরে নিয়ে যান আসামিরা। বাদীকে সাফাত আহমেদ একাধিকবার এবং বান্ধবীকে নাঈম আশরাফ একাধিকবার ধর্ষণ করেন। আসামি সাদমান সাকিবকে দুই বছর ধরে চেনেন মামলার বাদী। তাঁর মাধ্যমেই ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে সাফাতের সঙ্গে দুই ছাত্রীর পরিচয় হয়।
এজাহারে আরো বলা হয়েছে, ঘটনার দিন সাফাতের জন্মদিনে দুই ছাত্রী যান। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী (অজ্ঞাতপরিচয়) তাঁদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে যান।
এজাহারে আরো উল্লেখ আছে, হোটেলে যাওয়ার আগে বাদী ও তাঁর বান্ধবী জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। তাঁদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। অনুষ্ঠান হবে হোটেলের ছাদে। সেখানে যাওয়ার পর তাঁরা ভদ্র কোনো লোককে দেখেননি। সেখানে আরো দুই তরুণী ছিলেন। বাদী ও বান্ধবী দেখেন সাফাত ও নাঈম ওই দুই তরুণীকে ছাদ থেকে নিচে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় বাদীর বন্ধু ও আরেক বান্ধবী ছাদে আসেন। পরিবেশ ভালো না লাগায় তাঁরা চলে যেতে চান। এই সময় আসামিরা তাঁদের গাড়ির চাবি শাহরিয়ারের কাছ থেকে নিয়ে নেন। তাঁকে খুব মারধর করেন। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিওচিত্র ধারণ করতে বলেন। বাদীকে নাঈম আশরাফ মারধর করেন এবং তিনি প্রতিবাদ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। এরপর বাদী ও বান্ধবীর বাসায় দেহরক্ষী পাঠানো হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। তাঁরা এতে ভয় পেয়ে যান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিক অসুস্থতা তাঁরা কাটিয়ে ওঠেন এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলার সিদ্ধান্ত নেন। এতে মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হয়।
ধর্ষণের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে দুই ছাত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ধর্ষিত হয়েছিলেন কি না তা জানতে নমুন সংগ্রহ করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ জানান, স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তিনি ছাড়া কমিটির বাকি সদস্যরা হচ্ছেন কবির সোহেল, মমতাজ আরা, নিলুফার ইয়াসমিন ও কবিতা সাহা। বোর্ডের অধীনে দুই তরুণীর মাইক্রোবায়োলজি, রেডিওলজি ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট আসতে প্রায় দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।