নামে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ত্রাণকাজে নেই!
সংগঠনের নাম আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সভাপতির ভাষ্য, এর উদ্দেশ্য ‘জনগণের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া’। কিন্তু প্রতিষ্ঠার বহু বছর পরও ‘সেটা করা হয়ে ওঠেনি’।
নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজ উদ্যোগে দুর্গত মানুষের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের কাজ করে না স্বেচ্ছাসেবক লীগ। কেবল আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে যেসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তা কেবল আওয়ামী লীগেরই জন্য।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনগণের দুর্ভোগ, লঞ্চডুবি, ভবনধস, পাহাড়ধস, বড় বড় অগ্নিকাণ্ড-কোনোকিছুতেই সাংগঠনিকভাবে মানুষের পাশে থাকতে দেখা যায় না স্বেচ্ছাসেবক লীগকে।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছারও। তৃণমূলের নেতারাও এ অভিযোগ অস্বীকার করতে পারেননি।
হাওরে নেই, পাহাড়ধসেও নেই
সম্প্রতি সুনামগঞ্জে হাওরে ঘটেছে বিপর্যয়। ফসলি জমি ডুবে যায় পানিতে। এমনকি হাওরের মাছও মারা যায়। ওই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনসহ একাধিক সংগঠন ত্রাণসহায়তা নিয়ে ওই এলাকায় যায়। কিন্তু আলাদা করে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুনামগঞ্জ অঞ্চলের একাধিক ব্যক্তি এনটিভি অনলাইনকে জানান, তারা কোনো প্রকার স্বেচ্ছাসেবকমূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন না। তাদের কাজ মূল দলের নেতাকর্মীরা তৃণমূলে ত্রাণ বিতরণে এলে কিংবা জনসভা সরতে এলে তাদের সঙ্গে ছবি তোলা, স্লোগান দেওয়া বা তাদের নির্দেশ পালন করা।
সুনামগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুবায়ের আহমেদ অপু বলেন, ‘আমরা নিজেদের সিদ্ধান্তে কোনো কাজ করি না। দলের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে থাকি।’
নেত্রকোনা জেলাও ডুবেছে হাওরের পানিতে। সেখানেও দেখা মেলেনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম। জুবায়েরের মতো সংগঠনের নেত্রকোনার সভাপতি মারুফ হাসান অভ্রও জানালেন, আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী সংগঠন কাজ করে।
রাঙামাটির পাহাড়ধসের ঘটনায়ও মেলেনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম। এ ক্ষেত্রেও সংগঠন আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করে বলে জানান রাঙামাটি শাখার সভাপতি ছাওয়াল উদ্দিন।
সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানায়, দলের নির্দেশনা বাস্তবায়নই তাদের মূল উদ্দেশ্য। এর বাইরে তাঁদের কাজ করার আপাতত পরিকল্পনা নেই। বন্যাদুর্গত অঞ্চল নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এবং বিপর্যস্ত পাহাড়ি অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁরা জানান, মূল দলের নির্দেশনার বাইরে তারা কোনো কাজ করে না।
আমাদের পাবনা প্রতিনিধি এ বি এম ফজলুর রহমানের পাঠানো প্রতিবেদনে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকাতেও নেই স্বেচ্ছাসেবক লীগের কার্যক্রম।
বানভাসিদের পাশে নেই, তবে ‘রাখছে সতর্ক নজর’
সিরাজগঞ্জের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছে, বন্যাকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা। ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম সজল, সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলাম জেহাদ ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ভিপি মো. শামীম খান ও যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলমগীর আলমসহ উপজেলা পর্যায়ের কোনো নেতাকর্মীকে বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা যায়নি।
সরেজমিন বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলা প্রশাসন ও কিছু জনপ্রতিনিধির বন্যা আক্রান্ত এলাকায় ত্রাণ নিয়ে কাজ করতে দেখা গেলেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জিহাদ আল ইসলাম জিহাদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখনো বন্যাকবলিতদের পাশে দাঁড়ানো হয়নি। তবে বন্যাকবলিতদের ব্যাপারে জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সতর্ক নজর রাখছে। এরই মধ্যে চৌহালী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের বর্ধিত সভায় যেসব এলাকায় বন্যা হয়েছে, সেসব উপজেলায় দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য শিগগির কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে। তারপরও কোথাও পরিস্থিতির অবনতি হলে বা ত্রাণ অপ্রতুল হলে সেখানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত রয়েছে।’
এ বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাউছার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের উদ্দেশ্য জনগণের জন্য স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই, সেটা করা হয়ে ওঠেনি।’
আবু কাউছার আরো বলেন, ‘দলের নির্দেশনা অনুযায়ী তৃণমূলের নেতারা আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তা করছেন। তবে বিষয়টা ভাবব। আগামী দিনে পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করব আশা করি।’
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘আমার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে যে, এই সংগঠনগুলো একটি সুন্দর চিন্তা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আজ সংগঠনের নেতাকর্মীরা জানেই না যে, তাদের কাজ কী, তাদের গন্তব্য কোথায়। প্রত্যাশা করছি স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা দল তাদের করণীয় কী বুঝতে সক্ষম হবে এবং মানুষের জন্য কাজ করবে।’