সিদ্দিকের মায়ের প্রশ্ন, আমরা এখন কী করুম বাবা
‘সিদ্দিকরে তিন বছরের থুইয়া ওর বাপ মরছে। বড় পোলাডা রডের কাম কইরা ভাইডারে এতদূর পড়াইছে। এখন তো ওর চোখ গেছেগা, আমরা এখন কী করুম বাবা? পোলাডারে সরকার যেন একটা চাকরি দেয়। হেয় কী অপরাধ করছে?’
আজ শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ষষ্ঠতলার ৬২৮ নম্বর কক্ষের পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের মা সোলেমা বেগম।
২৫ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন সোলেমা। এরপর দুই ছেলেকে মানুষ করতে দিনের পর দিন অন্যের বাড়িতে কাজ করেছেন। আজ সিদ্দিকুরের অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকরা যখন জানালেন, চোখ ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি এই মা। সিদ্দিকুরকে দেখতে আসা সহপাঠীদের দেখে কাঁদছিলেন আর প্রলাপ করছিলেন তিনি। মায়ের কাঁধে হাত রেখে পাশেই বসে ছিলেন সিদ্দিকুরের বড় ভাই নায়েব আলী।
ছোট ছেলে সম্পর্কে সোলেমা বেগম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘বাবা দুইডা পোলা, অভাবের কারণে হেরে তো বাড়ি থাইকা ঠিকমতো টেকা-পয়সা কিছুই দিতে পারি নাই। হেয় নিজেই ইনকাম কইরা পড়ার খরচ চালায়। চাকরি বাকরি নয়, একটা দুইটা পোলারে প্রাইভেট পড়াইত মনে হয়। বড় পোলাডা রডের কাম করে ছুডু ভাইরে যা পারে দেয়, হেরোও তো তিনডা বাচ্চা। অভাবের সংসার।’
ছেলের খবর কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে সোলেমা বেগম বলেন, শুরুতে তাঁকে জানানো হয় যে সিদ্দিকুরের চোখে গ্যাস গেছে। তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। ঢাকা থেকে টেলিফোনে সিদ্দিকুরের সহপাঠীরা এই খবর প্রথমে দেন বলে জানান তিনি। বলেন, এটুকু শুনেই তিন অচেতন হয়ে পড়েন। পরে খবর পেয়ে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় যান তাঁর বড় ছেলে। এরপর টেলিভিশনে খবর দেখে কান্নাকাটি করে সোলেমাও ঢাকায় চলে আসেন বলে এনটিভি অনলাইনকে জানান।
সিদ্দিকের ভাই নায়েব আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভাই, আমি কিছুই চাই না। আমার ভাইডারে সুস্থ কইরা দেন। আমার ভাইয়ের জন্য দোয়া চাই, আল্লাহ যেন ভাইডারে খালি সুস্থ কইরা দেয়।’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
সিদ্দিকের পাশে সহপাঠীরা
দুই চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা সিদ্দিক হয়তো জানতেও পারছেন না যে কত মানুষ তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই তাঁর সহপাঠী এবং কলেজের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থী। সরকারি তিতুমীর কলেজের প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত সব বিভাগের শিক্ষার্থীরা সিদ্দিকের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন পরিমাণে টাকা সাহায্য করছেন। বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা একের পর পর ছুটে আসছেন আর সিদ্দিকের জন্য সংগ্রহ করা টাকা এনে তুলে দিচ্ছেন তাঁর মায়ের হাতে।
দুপুর ১টার দিকে তিতুমীর কলেজের গণিত বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন শিক্ষার্থী এসে সিদ্দিকুরের চিকিৎসার জন্য সংগ্রহ করা অর্থ একটি খামে ভরে তুলে দেন সোলেমা বেগমের হাতে। এঁদের একজন সাদ্দাম হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা আমাদের কলেজের সকল বিভাগে বলে দিয়েছি, যেভাবে যে যতটুকু পারে যেন সিদ্দিকের এই বিপদে এগিয়ে আসে। এ জন্য আমরা নিজেরাই ক্যাম্পেইন চালিয়ে নিজেদের বিভাগ থেকে ফান্ড সংগ্রহ করছি।’
ওই দিন সিদ্দিকুরের সঙ্গেই আন্দোলনে ছিলেন শেখ ফরিদ। তিনি বলেন, ‘সেদিন আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি প্রায় শেষপর্যায়ে ছিল। আমরা আর কিছুক্ষণ পরেই চলে আসতাম। এ সময় হঠাৎ করেই কিছু পুলিশ আমাদের ওপর টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা শুরু করে। তখন আমরা পেছনে উল্টো দৌড় দেই, কারণ পুলিশ একই সাথে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিল, আর তখন সিদ্দিককে দেখি মাটিতে পড়ে যায়। এরপর তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
চিকিৎসার খরচ নয়, সিদ্দিকের জন্য চাকরি দাবি
সিদ্দিকুরের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা খুবই কম বলে জানিয়েছেন অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (গ্লুকোমা) ইফতেখার মো. মুনির।
এমন খবর শুনেই ভেঙে পড়েছেন সিদ্দিকের পরিবারের সদস্যসহ তাঁর সহপাঠীরা। দুই চোখ হারালে মেধাবী সিদ্দিকের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে চিন্তিত সবাই।
তবে সিদ্দিকের চিকিৎসার খরচ তাঁরাই চালাবেন বলে জানালেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সিদ্দিককে দেখতে আসা কয়েকজন সহপাঠী। সরকারের প্রতি তাঁদের অনুরোধ, সিদ্দিককে যেন একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
সিদ্দিক সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁর সহপাঠী মো. শাহ আলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সিদ্দিক অনেক মেধাবী ছাত্র। অভাবের সংসারে থেকেও সে ভালোমতো পড়াশোনা চালাচ্চে। সে এসএসসিতে পেয়েছে এ প্লাস (জিপিএ ৫), এইচএসসিতে এ গ্রেড (জিপিএ ৪.৮০)। এ ছাড়া কলেজে ভর্তির পর অনার্স প্রথম বর্ষে সিদ্দিকুরের সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ২৯ পয়েন্ট এবং দ্বিতীয় বর্ষে ছিল ৩ দশমিক ২৫ পয়েন্ট যা প্রথম শ্রেণির সমমান। এখন এই চোখ নিয়ে কীভাবে ভবিষ্যৎ গড়বে সে। তাই আমাদের সবার আবেদন সরকারের কাছে, সিদ্দিকের যেন একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়।’
এ সময় সেখানে উপস্থিত সব শিক্ষার্থীই একবাক্যে সরকারকে উদ্দেশ করে সিদ্দিকের একটা চাকরির অনুরোধ করলেন।
এর আগে সিদ্দিকুরের চোখে অস্ত্রোপচার শেষে ডা. ইফতেখার মুনির সাংবাদিকদের জানান, অস্ত্রোপচারে তাঁর ডান চোখের ভেতর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কর্নিয়া, জেলসহ অনেক কিছু বের করা হয়েছে। আর বাম চোখের ভেতরে রক্তসহ অনেক কিছু জমা রয়েছে। সেগুলোকেও ওয়াশ করা হয়েছে। তবে তাঁর দুই চোখ ঠিক হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক।
এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার মুনির বলেন, ‘বিদেশে চিকিৎসা করলে তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেতে পারেন কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমরা একটি মেডিকেল বোর্ড বসাব। বোর্ডেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে, উন্নত চিকিৎসায় তাঁর চোখের দৃষ্টি ফিরবে কি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আর বাম চোখ ভালো হওয়ার কিছুটা সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা-ও খুবই কম।
গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রুটিনসহ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা শাহবাগে অবস্থান নেন। এ সময় সাত দফা দাবিতে জাদুঘরের সামনে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারী কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, আন্দোলনের জন্য শাহবাগ থানার পুলিশ তাঁদের আধা ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। পুলিশের বেঁধে দেওয়া সময় পার হয়ে গেলে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে পুলিশ। এ সময় শাহবাগ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে।
আহত শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুলিশের রাবার বুলেট সিদ্দিকুর রহমানের চোখে বিদ্ধ হয়েছে বলে দাবি করেন সহপাঠীরা। পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়। পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে দ্রুত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
অবশ্য শুরু থেকেই রাবার বুলেটে সিদ্দিক আহত হওয়ার কথা অস্বীকার করে আসছিল পুলিশ। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘ছাত্রদেরই নিক্ষেপ করা ঢিল সিদ্দিকুর রহমানের চোখে লাগে। এতে তিনি আহত হন। পুলিশের রাবার বুলেটে তিনি আহত হননি।’