২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার ‘শেষ পর্যায়ে’
বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। এ বছরই রায় হয়ে যাবে বলে আশা করছেন সরকারি কৌঁসুলি।
মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি পৃথক মামলায় আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে মোট ৫২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। দীর্ঘ প্রত্যাশিত এ মামলার রায় চলতি বছরের মধ্যেই হবে বলে তিনি আশাবাদী।
বর্তমানে এ মামলায় আসামিপক্ষের ১৩ জনের সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। আসামিপক্ষের আরো ৮ থেকে ১০ জনের সাফাই সাক্ষী নেওয়া হবে। পরে এ মামলায় উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করা হবে।
মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এর আগে দুজন তদন্ত কর্মকর্তাসহ (আইও) ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাঁদের আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরা সম্পন্ন করেন। এ মামলায় ৪৯১ জনের মধ্যে ২২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
অভিযুক্তদের মধ্যে ১৯ জন এখনো পলাতক। অভিযুক্তদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামী সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় এবং অপর এক মামলায় হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এ ছাড়া আটজন জামিনে রয়েছেন। অপর ১৯ আসামি বিভিন্ন দেশে পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
পলাতক ১৯ আসামি হলেন—তারেক রহমান লন্ডনে, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরবে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন যুক্তরাষ্ট্রে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালিন ও তাঁর ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছেন।
জঙ্গিনেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (পূর্ব) এবং উপকমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, তাঁদের বেশির ভাগই পাকিস্তানে রয়েছেন। তবে অপর অভিযুক্ত পলাতক আসামি হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি।
পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু—তাঁরা দুজন বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টুও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত।
অভিযুক্ত ৫২ জনের মধ্যে বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু বর্তমানে জেলে রয়েছেন। এ মামলায় পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদাবকস চৌধুরী এবং সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক এসপি রুহুল আমিন, সিআইডির সাবেক এএসপি আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ জামিনে রয়েছেন।
২০০৮ সালের ১১ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২১ আগস্টের ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলায় প্রথম চার্জশিট দাখিল করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু এবং ২১ হুজি নেতাকর্মীসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
নতুন করে তদন্তের পর ২০১২ সালের ৩ জুলাই অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে পৃথক দুটি সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে। দুটি মামলায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫২ জন।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই সিরিজ গ্রেনেড হামলা চালানো হলেও তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাৎক্ষণিকভাবে এক মানববলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।
মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকার কারণে তাঁর অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এদিকে শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তাঁর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসাহাক মিয়া।
গুরুতর আহত ব্যক্তিরা হলেন শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ হানিফ, এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাসিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা আখতার, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দীপ্তি, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন ও মামুন মল্লিক।