‘দেশের চিকিৎসকরা সুযোগ পেলে আরো ভালো করবেন’
আবুল বাজনদার, মুক্তামনি, তোফা-তহুরা। একের পর এক বিরল ব্যাধি ও জটিলতা নিয়ে কাজ করছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। প্রথাগত আগুনে পোড়া রোগীদের নিয়ে তো বটেই, বার্ন ইউনিট কাজ করে জন্মগত ত্রুটিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেন বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্তলাল সেন। সঙ্গে ছিলেন দুই সহকর্মী সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রবিউল করিম খান ও সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ। নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের পাশাপাশি বার্ন ইউনিট নিয়েও কথা বলেন তাঁরা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের সাংবাদিক চন্দন সাহা রায়, আহমেদ আল-আমীন ও শাশ্বতী মাথিন।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তামনির সর্বশেষ অবস্থা কী?
সামন্তলাল সেন : ভালো আছে। আমরা হাতের ব্যান্ডেজ খুলেছিলাম। এখন সে ভালো আছে। এখন আমরা তাকে আরেকটি অপারেশন (অস্ত্রোপচার) করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছি। তার হাতে চামড়া লাগাতে হবে। সেটা যত দ্রুত করা যায় তত ভালো।
এনটিভি অনলাইন : পরবর্তী অপারেশন কবে নাগাদ হতে পারে?
সামন্তলাল সেন : আমরা আবার মেডিকেল বোর্ডে সিদ্ধান্ত নেব। তবে মনে হচ্ছে, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে হবে। আমরা আশা করছি, আগামী সপ্তাহে তার অপারেশন হবে। তার আগে একটি মেডিকেল বোর্ড হবে। মুক্তামনির শেষ অবস্থা এই। আমরা আশা করছি, সবার দোয়া পেলে মুক্তামনি ভালো হবে।
আবুল বাজনদার ও তাঁর পরিবারের ছবি হাতে ডা. সামন্তলাল সেন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
এনটিভি অনলাইন : বেশ রক্তক্ষরণের আশঙ্কা করেছিলেন আপনারা...
সামন্তলাল সেন : রক্তক্ষরণের আশঙ্কা ছিল। এই রোগটিতে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। তবে এখন ভালো রয়েছে।
বাংলাদেশে এখন ভালো কাজ হয়। এটি কিন্তু এখন গর্বের বিষয়। আপনি দেখেন, ঢাকা মেডিকেলে দুটো বাচ্চা তোফা তহুরা- এরপর আবুল বাজানদার, মুক্তামনি। আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা সুযোগ পেলে ভবিষতে আরো ভালো করবে। তাদের ইচ্ছে রয়েছে। তবে ফ্যাসিলিটির অভাবে কাজ করতে পারছে না।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তামনিকে তো আপনারা সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন...
সামন্তলাল সেন : মুক্তামনির বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কনসার্ন (জ্ঞাত)। উনি উনার ডাক্তার পাঠালেন, সেই ডাক্তার দেখার পর আমি একদিন গেলাম। তারপর আমি এই ছবিটা (হাতে টিউমারসহ মুক্তামনির ছবি) দেখালাম। দেখানোর পর উনি বললেন, তুমি একটি কাজ করো বাইরে যোগাযোগ করো, যদি বাইরে গেলে সে ভালো হয়ে যায়, তাহলে আমি পাঠিয়ে দেব। এরপর আমি আর ডা. লেনিন (প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একজন পরিচালক) আলোচনা করলাম। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আমাদের একটি সম্পর্ক রয়েছে বাই-লেটারাল, ওইভাবে আমি যোগাযোগ করি। ওরা বলল, ছবি পাঠাও। আমি ছবিসহ সব কাগজপত্র পাঠালাম। এরপর ভিডিও কনফারেন্স করলাম। ভিডিও কনফারেন্সে মুক্তমনিকে দেখালাম। দেখানোর পর ওরা আমাদের লেখল, ‘দিস কেস ইস ইনঅপারেবল ও ইনকিউরেবল’। মানে অপারেশনও করা যাবে না, নিরাময়ও করা যাবে না। সে কথা আমি আবার গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। উনি আমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে তোমরা যা পার করো।’ আমার কথা হচ্ছে, মুক্তামনি তো আমাদের দেশের মেয়ে, ওরা (সিঙ্গাপুর) হয়তো অনেক কিছু চিন্তা করে ভেবেছে, যদি কোনো ঝুঁকি হয়। ওরা ফেলে দিলেও আমরা তো ফেলে দিতে পারব না। আমরা কিন্তু মেডিকেল বোর্ড ওর ( মুক্তামনি) মা-বাবাকে ডেকে সবকিছু বলছি। ভালো-মন্দ, কী হতে পারে বলেছি। মা-বাবা বলেছেন, ‘স্যার, যা হওয়ার হবে’। আমি এটাও বলেছি, ‘দেখেন, অপারেশন করার সময় টেবিলেই মারা যেতে পারে। সেটার ঝুঁকি রয়েছে।’ তারা বলছে, ‘কিছু করার নেই। আমরা আল্লাহকে বলি। না হলে তো বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে। গন্ধ হবে। আস্তে আস্তে মারা যাবে। চেষ্টা করে দেখি।’ যাই হোক, ওপরওয়ালার ইচ্ছে, এখন পর্যন্ত ভালো আছে।’
এনটিভি অনলাইন : সিঙ্গাপুর রিজেক্ট করেছে কেন?
সামন্ত লাল সেন : তার একটি ফুসফুস কাজ করছে না। আরো অনেক টেকনিক্যাল বিষয় আছে। যেসব কারণে তাঁরা কোনো রিস্ক নিতে চায়নি।
মোহাম্মদ রবিউল করিম খান : এ ক্ষেত্রে রক্ত বের হওয়ার পর রক্ত জমাট বাঁধা গুরুত্বপূর্ণ। তার প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজার ছিল। যেহেতু আমরা এত বড় একটি জিনিস কাটব। রক্তপাতের আশঙ্কা রয়েছে।
২০০৩ সালে বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের নিয়ে ডা. সামন্তলাল সেন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
একবার অন্য জায়গায় চিকিৎসা চলাকালীন মুক্তামনিকে নয় মাস যক্ষ্মা রোগের ওষুধ দিয়েছিল। যক্ষ্মার চিকিৎসা অনেকটা ক্যানসারের চিকিৎসার মতো। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এই অবস্থায় তার অনেক রকম সংক্রমণ হয়। যেমন ফাঙ্গাল ইনফেকশন, ভাইরাল ইনফেকশন ইত্যাদি। সেও এ রকম মাল্টি ফ্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্ত ছিল। এই সংক্রমণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যেত না, যদি সার্জারি করি। ওরা ( সিঙ্গাপুর) অনেক কিছু চিন্তা করে। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা একটু ঝুঁকি নেই। মা-বাবা একটু ঝুঁকি নেয়। আমরা ভাবি, না করলে তো ক্ষতিই হচ্ছে। তার ফুসফুসের সমস্যা ছিল, সার্জারির পর রক্ত জমাট বাঁধা নিয়ে ঝুঁকি ছিল। আমরা প্রায় সব সমস্যা ওভারকাম করতে পেরেছি।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তামনির কতটি অস্ত্রোপচার লাগতে পারে? কতদিন পরপর হতে পারে?
মোহাম্মদ রবিউল করিম খান : এটা এখনো বলা যাচ্ছে না। তার শরীরের অবস্থা বুঝে অস্ত্রোপচারগুলো করা হবে।
এনটিভি অনলাইন : ওর হাতটা কি শেষ পর্যন্ত রক্ষা করা যাবে? কী মনে হচ্ছে আপনাদের?
মোহাম্মদ রবিউল করিম খান : এটাই কাম্য।
এনটিভি অনলাইন : এ ক্ষেত্রে একটি কথা বলা হয়ে থাকে যে, রোগী ও পরিবারের সাপোর্ট একটি বড় বিষয়…
মোহাম্মদ রবিউল করিম খান : মুক্তামনির মা- বাবার একটি ভালো বিষয় হলো, তাঁরা আমাদের প্রতি আস্থা রাখতে চাইছেন। মুক্তামনিও খুব লক্ষ্মী।
এনটিভি অনলাইন : আবুল বাজনদার বা মুক্তামনি, বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সাফল্য বলে মনে করে মানুষ…
সামন্তলাল সেন : আমি একটি কথা বলি। আমার পরের যে জেনারেশন এদের মধ্যে মেধা রয়েছে, আন্তরিকতা রয়েছে। এই আন্তরিকতা যদি ধরে রাখা যায়, এদের যদি ভালো ফ্যাসিলিটি দেওয়া যায়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অনেক ভালো কাজ করবেন।
আপনি দেখেন, আমরা যে ইনস্টিটিউট বানাচ্ছি, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এই হাসপাতালটি কিন্তু ৫০০ বেডের, অত্যন্ত আধুনিক একটি হাসপাতাল হচ্ছে। একদিকে বার্নের চিকিৎসা, আরেকদিকে প্লাস্টিক সার্জারি। এখানে সব ফ্যাসিলিটি থাকবে। আজকে মুক্তামনি বলেন কিংবা ঢাকা মেডিকেলের যমজ বাচ্চা বলেন- এদের অজ্ঞান (এনেসথেসিয়া) করাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি আমাদের চিকিৎসকরা করতে পেরেছেন। এটা আজ থেকে ১০ বছর আগে অসম্ভব ছিল। চিন্তাই করা যায় না। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে খুবই আশাবাদী যে, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের ভালো ফ্যাসিলিটি দিলে, অবশ্যই ভালো করবে। ভালো খারাপ তো সব পেশাতেই রয়েছে। আপনাদের পেশাতেও রয়েছে, আমাদের পেশাতেও রয়েছে। ভালো কাজটিকে ফুটিয়ে তোলা দরকার। আজকাল মিডিয়া এটা করছে। এ জন্য আমি মিডিয়ার প্রতি খুব খুশি। এতে হবে কী- এই কাজগুলো করার পর পরবর্তী প্রজন্ম এনকারেজ হবে। এটা আমার বিশ্বাস তারা ভালো করবে।
আমাদের দেশের ডাক্তাররা কী করবেন বলুন? ১০০ বেডের হাসপাতালে ৩০০ রোগী। এই রোগী সামাল দিতে তো তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যায়।
রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ডা. সামন্তলাল সেন এবং অন্যান্য চিকিৎসক। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
এনটিভি অনলাইন : আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে এখানে কাজ করছেন। কোন ধরনের রোগী আপনারা বেশি পাচ্ছেন? আগুনে পোড়া নাকি এসিডে পোড়া?
সামন্তলাল সেন : আমরা সবাই প্লাস্টিক সার্জন। আমার ক্যারিয়ার আমি শুরু করি প্লাস্টিক সার্জারিতে। আমি যখন তরুণ প্লাস্টিক সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন আমারও কিন্তু স্বপ্ন ছিল আমি একদিন বিরাট প্লাস্টিক সার্জন হবো। মানুষের চেহারা সুন্দর করব। অনেক বড় লোক হবো। অনেক গাড়ি থাকবে। প্লাস্টিক সার্জনরা পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়লোক হয়। সেই স্বপ্ন নিয়ে কিন্তু আমি আমার কেরিয়ারটা শুরু করেছিলাম। আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসা করা প্লাস্টিক সার্জারির একটি অংশ। আমি যখন ঢাকা মেডিকেলে আসি, এই রোগীদের সংস্পর্শে এসে আমার জীবনের সব স্বপ্ন চলে গেল। আমি তখন ভাবলাম এদের বাঁচানো যায় কীভাবে। আগুনে পোড়া রোগীরা রাস্তাঘাটে, বারান্দায়, বাথরুমের পাশে পড়ে থাকত। সেই যুদ্ধ করে এটা দাঁড় করিয়েছি। বার্ন হলো বাংলাদেশের একটি বড় কমপোনেন্ট। এর সঙ্গে ঠোঁটকাটা, তালুকাটা, ক্যানসার রোগের চিকিৎসা, মুক্তামনির মতো টিউমার, জন্মগত টিউমার- এগুলোর চিকিৎসা করা হয়। এগুলো হলো রিকনসট্রাকটিভ সার্জারি। এগুলো হলো প্লাস্টিক সার্জারির কাজ। এ ছাড়া আপনি দেখবেন, রাস্তাঘাটে একটি দুর্ঘটনা হলে হাত কেটে যায়, এই হাত যদি ছয় ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসে, আমরা ব্যবস্থা করব। এখন কিন্তু মাইক্রো সার্জারি করে হাত লাগানো যাবে। এইগুলোও কিন্তু প্লাস্টিক সার্জনের কাজ। এটা কলকাতাতেও হয়। এটা বাংলাদেশে হচ্ছে, তবে সীমিত আকারে। তবে আমরা যখন নতুন হাসপাতাল করব, এটাও একটা নিয়মিত কাজ হয়ে যাবে।
এনটিভি অনলাইন : কোন ধরনের রোগী বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে বেশি পাচ্ছেন?
সামন্তলাল সেন : আমরা এখানে বেশি পাচ্ছি আগুনে পোড়া রোগী। এ ছাড়া ঠোঁটকাটা, তালুকাটা, ক্যানসার, জন্মগত ত্রুটি, যেমন হাতের কনট্রাকচার, হাত বাঁকা হয়ে যাচ্ছে- এই ধরনের রোগীও আমরা পাচ্ছি।
এনটিভি অনলাইন : এটা তো ঢাকার অবস্থা। ঢাকার বাইরে কীভাবে কাজ হচ্ছে?
সামন্তলাল সেন : ঢাকার বাইরে ১৪টি মেডিকেল কলেজে এখন বার্ন ইউনিট রয়েছে। বাইরে আমাদের বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। রংপুর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল প্রত্যেক জায়গায়।
তাঁরা স্বল্প পরিসরে কাজ করছেন। একেও আরো বাড়াতে হবে। সেটার জন্যই তো আজকে এত বড় ইনস্টিটিউট বানানো। প্রধানমন্ত্রীর নামে যে ইনস্টিটিউট হচ্ছে, এটি হলে আমরা আরো দক্ষ জনবল বাড়াতে পারব। আমাদের কিন্তু জনবল কম রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছরে অন্তত ছয় লাখ লোক পুড়ে যায়। সেই অনুযায়ী প্লাস্টিক সার্জন ৯২ জন। আমার মতে, অন্তত ৪০০ দরকার। সেই ৪০০ প্লাস্টিক সার্জন তো একদিনে বানানো সম্ভব নয়। এটি আলাদা ইনস্টিটিউট হলে করা সম্ভব। কারণ, আপনি ঢাকাতে যত কিছুই করেন, তবে বিকেন্দ্রীকারণ না করলে এই সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ, পোড়ে কিন্তু গরিব মানুষ। ঠোঁটকাটা, তালুকাটা হয় গরিব শ্রেণির। ওই টেকনাফ- তেঁতুলিয়া থেকে রোগী ঢাকা আসা খুব অসম্ভব। রংপুর, দিনাজপুর প্রত্যেকটি মেডিকেলে ভালো ইউনিট হলে এই সমস্যার সমাধান হবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনি খুব ছোট পরিসরে কাজ শুরু করেছিলেন। সে সম্পর্কে একটু বলুন…
সামন্তলাল সেন : স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যখন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ডা. গাস্ট বলে একজন আমেরিকান প্লাস্টিক সার্জনকে আনেন। উনি তখন অনুভব করেন, বাংলাদেশে প্লাস্টিক সার্জারি দরকার। তখন তিনি লুধিয়ানা থেকে একজন ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক সার্জন নিয়ে আসেন, ডা. বাদলি। তখন আমি তরুণ ডাক্তার। গ্রাম থেকে এসেছি, গ্রামে চাকরি করে। তখন একটা হিরো হিরো ভাব। অনেক ভাবসাব। তখন আমিও প্লাস্টিক সার্জারিতে যোগ দিলাম। বাস, লারে-লাপ্পার জীবন শুরু হয়ে গেল। এই আমার প্লাস্টিক সার্জারি পাঁচ বেড দিয়ে শুরু হলো। যুদ্ধ করতে করতে ৫০, ১০০, ৩০০, ৫০০। এর মধ্যে অনেক কষ্ট। আজকে আমার ভালো লাগে, নতুন প্রজন্মের কাজ করার জায়গা রয়েছে। এমনও একদিন গেছে আমাদের একটি ওটি করার জায়গা ছিল না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়েছে। অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। মানে, আমি যখন এই ৫০ বেড বানাই, এমনও শুনতে হয়েছে উনি টাকা মেরে কোলকাতায় গিয়ে সল্টলেকে বাড়ি বানাবেন। হা হা হা…। এগুলো এখন আমার ভালো লাগে। আমি কোথাও যাইনি। এটা আমার দেশ। আমি এ দেশেই থাকব। এই দেশেই মরব।
এনটিভি অনলাইন : বর্তমানে এখানে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন?
সামন্তলাল সেন : আমরা যে এই হাসপাতালে কাজ করছি, এতে আমাদের সীমিত আকারে কাজ করতে হচ্ছে, জনবল কম। চিকিৎসক, প্রশিক্ষিত নার্স কম। তবে আমরা আশা করছি, নতুন বিল্ডিং হয়ে গেলে আমরা সমস্যা অনেকটা কাটিয়ে ওঠতে পারব।
এখন জনবল কাঠামো, আধুনিক যন্ত্রপাতি এগুলোর সমস্যা। জনবলের সমস্যাটা বেশি। আর একটি হলো বাইরের মেডিকেল কলেজগুলোকে শক্তিশালী করলে রোগীর চাপটা কমে যাবে।
এনটিভি অনলাইন : আবুল বাজনদারকে তো আপনারা ফলোআপে রেখেছেন? মুক্তামনির বিষয়ে কি আপনাদের এ রকম চিন্তা-ভাবনা রয়েছে?
সামন্তলাল সেন : এই মুহূর্তে আমাদের এ রকম কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। আগে মুক্তামনি সুস্থ হোক। তার কতটুকু অ্যাবিলিটি থাকে দেখব। আমি মনে করি যে, মুক্তামনির যদি এ রকম একটি ভালো পর্যায় আসে, আমরা যেকোনো জায়গায় তাকে প্রোভাইড করতে পারব।
আমি আরেকটি জিনিস বলব। সাফল্য কারো একক প্রচেষ্টায় আসে না। এটা একদম ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে সবার। আপনি মুক্তামনি বলেন, আবুল বাজনদার বলেন, এই হাসপাতালের প্রতিটি মানুষ ডিভোশন নিয়ে কাজ করেছে। এর জন্য এই সফলতা এসেছে। তা না হলে আসত না। আমি মুক্তামনির ব্যাপারে দেখেছি। আমাদের দেশের মানুষের মন অনেক ভালো। মুক্তামনিকে নিয়ে যেভাবে মিডিয়া সংবাদ প্রচার করেছে, রাস্তাঘাটে বহুলোক আমাদের বলেছে আমরা মুক্তামনির জন্য দোয়া করব। এই যে মানুষের একটি অনুভূতি এটি অতুলনীয়। এই হাসপাতালের অনেক ওয়ার্ডবয় আছে আমাকে বলে, ‘স্যার আমরা বাসায় বলে এসেছি আব্বা-আম্মাকে দোয়া করার জন্য।’ রাস্তাঘাটে, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের পিয়ন আমাদের বলেছে, ‘আমরা মুক্তামনির জন্য দোয়া করব।’ এই যে একটি ফিলিংস, এটা কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ইতিবাচক।
এনটিভি অনলাইন : মুক্তামনির চিকিৎসায় কতজন চিকিৎসক কাজ করছেন?
সামন্ত লাল সেন : মুক্তামনির অপারেশনে ২১ জন সার্জন ছিলেন। আর এ্যানেসথেসিয়ায় ছিলেন নয়জন। মোট ৩০ জন যুক্ত ছিলেন এখানে।
এনটিভি অনলাইন : আবুল বাজনদারের চিকিৎসা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন...
তানভীর আহমেদ : আবুল বাজনদারের ব্যাপারে আমাদের জ্যেষ্ঠ স্যাররা বললেন, পড়াশোনা শুরু করো। আমরা বিভিন্ন জায়গায় সার্চ করার পর দেখলাম। কিছু পাচ্ছিলাম না। আমরা কম ঝুঁকিপূর্ণ জিনিসগুলো নিয়ে গবেষণা করা শুরু করলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ল্যাবরেটরিতে এটি পাঠাতে হবে। সমস্যাটা কী সেটি আমাদের জানতে হবে। আমরা প্রথমে রোগ নির্ণয় করার চেষ্টা করলাম। কেউ তো আমাদের সাহায্য করতে পারছে না। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যেহেতু রোগটি রেয়ার, তাই আমাদের ধীরে ধীরে এগোতে হবে। প্রতিটি ধাপে কী রেসপন্স আসছে এরপর আমরা এগোব। অস্ত্রোপচারের আগে ড্রেসিং দিয়ে আমরা হাতকে ভিজিয়ে রেখেছি। আমরা যখন ওটিতে নিয়েছি দ্রুত জিনিসটা হয়ে গেছে। একে বলে ইলেকট্রো কটারাইজেশন। ত্বকের বিভিন্ন লেয়ার আস্তে আস্তে কাটতে হয়েছে। খুব বেশি কাটলে চামড়া লাগাতে হবে। আমরা চামড়া পাবো কই? তখন আমরা প্রথমে একটা লেয়ার, সাতদিন পর আরেকটি লেয়ার কেটেছি। এভাবে একটু একটু করে আমরা এগিয়েছি।
এনটিভি অনলাইন : কতগুলো সার্জারি লেগেছিল?
সামন্তলাল সেন : প্রায় ২৬টার মতো সার্জারি লেগেছিল। সে এখন পরিবারের সঙ্গে খুব ভালো আছে।
এনটিভি অনলাইন : তোফা-তহুরার বিষয়ে প্লাস্টিক সার্জনদের অংশগ্রহণটা কেমন ছিল?
তানভীর আহমেদ : তোফা-তহুরার বিষয়ে আমরা সবাই ওটিতে ছিলাম। প্লাস্টিক সার্জারির একটি বড় বিষয় রয়েছে সেখানে। একটি বিষয় ছিল তোফা-তহুরার মেরুদণ্ড, মেরুমজ্জা লাগানো ছিল। কোনো পরিকল্পনা ছাড়া যদি তাকে ওপেন করে ফেলেন আর ক্লোজ করতে পারবেন না। আমাদের শুরুটা হয়েছে খোলা থেকে একদম শেষ পর্যন্ত। ওদের কাটার পর দেখা গেল হাড়, মেরুমজ্জা লাগানো ছিল। অনেক ধাপে ধীরে ধীরে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আমাদের শুরুটা হয়েছে ওপেন থেকে একদম ক্লোজ পর্যন্ত। এখনো পর্যবেক্ষণ শেষ হয়নি। অস্ত্রোপচার করার ঝুঁকি ছিল। পায়ুপথের ওপরের অংশ, প্রস্রাবের নালি, রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেমের অংশ কাছাকাছি ছিল। এই তিনটিকে আলাদা করেছে কিন্তু প্লাস্টিক সার্জন।
এনটিভি অনলাইন : এই ধরনের রোগী যদি আপনাদের কাছে সাহায্য নিতে চায়, তাহলে ওই উপায়টা কী?
সামন্তলাল সেন : এখানে আসলেই হবে।
এনটিভি অনলাইন : যারা এসব বিরল রোগ নিয়ে আসছে, তাদের অধিকাংশই দরিদ্র। দরিদ্র্যতার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে কি?
সামন্তলাল সেন : সম্পর্ক একটাই, সেটি হলো মেডিকেল এডুকেশন বা শিক্ষা। এই যে মুক্তামনি। আজকে সে যদি কোনো বড়লোকের ঘরের মেয়ে হতো, তাহলে মা-বাবা দুজনেই কনসার্ন থাকত। একটা ছোট কিছু হলে ডাক্তারের কাছে যেত। একটি গরিব মানুষ, অশিক্ষিত এদের মেডিকেল এডুকেশন নেই, এই কারণে এরা ঝাঁড়ফুঁক, কবিরাজি এগুলোর চিকিৎসা করে। এজন্য শিক্ষা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আমার মনে হয়, এখন প্রত্যেকটি উপজেলায় হেলথ সেন্টার রয়েছে, এখানে সভা হয়। এসব জায়গায় মুক্তামনির মতো কেসের প্রতি সচেতনতার বিষয়টি বাড়াতে হবে। মুক্তামনির রোগ কিন্তু বিরল নয়। খুব প্রচলিত রোগ। আমরা সবাই দেখেছি। তবে মুক্তামনির জটিলতাটা বিরল। হেমানজিওমার চিকিৎসা করা কঠিন নয়। আমরা জানি এর কীভাবে চিকিৎসা করতে হয়। এজন্য আপনাদের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশের মানুষকে এই ম্যাসেজটা দেওয়া যায় যেকোনো একটি ছোট দাগ, কালো স্পট দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া।
এনটিভি অনলাইন : তাহলে প্রাথমিক অবস্থায় যদি আসত তাহলে কি সহজ হতো?
সামন্তলাল সেন : প্রাথমিক অবস্থায় যদি আসত সহজে ব্যবস্থাপনা করা যেত। অনেক ভালো অবস্থা হতো। সার্জারি নাও লাগতে পারত। এখন মুক্তামনির জীবন নিয়ে টানাটানি চলছে। অবহেলাজনিত একটি বিষয় রয়েছে।
শিক্ষা হচ্ছে আসল। আজ যদি মুক্তামনি বড়লোকের ঘরের মেয়ে হতো এটুকু হলেই তো আমার মতো একজন বাবা দৌঁড় দিত। এটা স্বাভাবিক।
তানভীর আহমেদ : এই সাব কনটিনেন্টের একটি সমস্যা হলো আমাদের হোমিওপ্যাথি, আয়ুবের্দিক, ভেষজ, কবিরাজি আর হলো পানি পড়া। যারা গ্রামের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা চলে যায় সেখানে। তাদের বলা হয়, জন্মগতভাবে এই ত্রুটিটা হয়েছে, একে তোমার মেনে নিতে হবে। নয়তো ক্ষতি হবে।
সামন্তলাল সেন : এখনো মানুষকে ফকির দিয়ে ঝাঁড়ফুঁক করা হয়। গাছের মধ্যে বেঁধে রেখে পিটাতে দেখি। এগুলো বন্ধ করা দরকার।
এনটিভি অনলাইন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
সামন্তলাল সেন : আপনাদেরও ধন্যবাদ।