‘এটা আমার দেশ, আমি এ দেশেই থাকব’
উত্তম-সুচিত্রার ছবি খুব পছন্দ ছিল তাঁর। পুরোনো দিনের গান শুনতে ভালোবাসেন। নিজেকে তো একটা সময় উত্তম কুমারই মনে হতো! চেহারা অবয়বে ছিলও সেই নায়ক নায়ক ভাব। নায়ক তিনি হয়েছেন, তবে সেটি সিনেমার পর্দায় নয়। জটিল রোগের চিকিৎসা করে, মানুষকে নতুন জীবন দিয়ে, মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বাংলাদেশে পোড়া রোগীদের সারিয়ে তুলতে তাঁর অবদান বিশাল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর তৈরি করেছেন ঢাকা মেডিকেলে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট। তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানীর চানখাঁরপুলে শুরু হয়েছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট।
২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডে শত শত পোড়া রোগীর চিকিৎসা, বৃক্ষমানব আবুল বাজনদার, বিরল রোগে আক্রান্ত শিশু মুক্তামনি, জোড়া শিশু তোফা-তহুরা—এদের চিকিৎসায় বাংলাদেশে মাইলফলক তৈরি করেছে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের চিকিৎসক দল।
বলছি বাংলাদেশের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্তলাল সেনের কথা। গত ২০ আগস্ট, রোববার সকালে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেন চিকিৎসাজীবনের কথা। জানান মুক্তামনি, আবুল বাজনদার, তোফা- তহুরার চিকিৎসার গল্প; নতুন বার্ন ইনস্টিটিউট তৈরি এবং তরুণ চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কথা।
ছেলেবেলায় কলাগাছে ইনজেকশন দিতেন ডা. সামন্তলাল সেন। ছবি : মো. ইব্রাহিম
‘কলাগাছে ইনজেকশন দিতাম’
ডা. সামন্তলাল সেনের জন্ম হবিগঞ্জ জেলার নাগুরা গ্রামে। ১৯৪৯ সালের ২৪ নভেম্বর। পাঁচ ভাইবোনের সংসার ছিল তাঁদের। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে চিকিৎসক হবে। ছোটবেলায় ডাক্তার সেজে কলাগাছেও ইনজেকশন দিতেন। বাবা জিতেন্দ্রলাল সেন সরকারি চাকরি করতেন। ডাক্তারি পেশায় আসা কেন? উত্তরে বললেন, ‘আমাদের গ্রামে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক ছিলেন, নাম ধীরেন চক্রবর্তী। তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হতাম। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছাটা তখন থেকেই।’
সব শিশুর মতো ছোটবেলাকে নিয়ে নানা মজার মজার ঘটনা রয়েছে তাঁর জীবনেও। ছোটবেলায় একবার ফড়িংকে মরিচ মনে করে খেয়ে ফেলেছিলেন। ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন বেশ। একবার ফুটবল খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে দেখেন, সামনে মহিষ দাঁড়িয়ে আছে। বললেন, ‘খুব ভয় পেয়েছিলাম!’
ডা. সামন্তলাল সেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নাগুরা ফার্ম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছেন সেন্ট ফিলিস হাই স্কুল থেকে ১৯৬৪ সালে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছেন দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে। এর পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার জন্য ভর্তি হন। ১৯৭২-৭৩ সালে পাস করে বের হন।
এর পর ভিয়েনা থেকে ১৯৮০ সালে প্লাস্টিক সার্জারিতে ডিপ্লোমা করেন। পরে জার্মানি ও ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নেন। ডাক্তারি পাস করার পর হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন। জানালেন, সেখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। কোনোরকম যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। সাইকেল চালিয়ে, নৌকায় চড়ে যেতে হতো। দেখতে লম্বা-চওড়া, সুন্দর ছিলাম। নিজেকে তখন উত্তম কুমার মনে হতো। আমার কাছে তখন অনেক অভিভাবক মেয়ে বিয়ে দিতে চাইতেন।’
এরপর ঢাকায় বদলি হয়ে এসে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কাজ শুরু করেন, জরুরি বিভাগে।
পোড়া রোগীদের জন্য কাজ
১৯৭১ সালের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডা. গাস্টকে এ দেশে নিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দেওয়ার জন্য। ডা. গাস্ট তাঁকে উৎসাহিত করলেন প্লাস্টিক সার্জারিতে কাজ করার জন্য। ডা. সামন্তলাল সেন বললেন, ‘ডা. গাস্ট অনুভব করেন, বাংলাদেশে প্লাস্টিক সার্জারি দরকার। তখন আমি তরুণ ডাক্তার। গ্রাম থেকে এসেছি, গ্রামে চাকরি করে। তখন একটা হিরো হিরো ভাব। অনেক ভাবসাব। তখন আমিও প্লাস্টিক সার্জারিতে যোগ দিলাম। ব্যস, লারে-লাপ্পার জীবন শুরু হয়ে গেল। ভাবতাম, অনেক ব্ড়লোক হব। বাড়ি-গাড়ি করব।’
‘১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বদলি হয়ে এলাম। তখন আমার বস ছিলেন অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্লাস্টিক সার্জন। তিনি আর নেই। তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করলাম। তাঁরা তখন আমাকে চাপ দিলেন পোড়া রোগীদের জন্য কোনো কাজ করতে।’
সামন্তলাল সেন বলেন, ‘এ সময় পোড়া রোগীদের দেখে খুব কাতর হয়ে পড়তাম। দেখতাম, তাঁরা মাটিতে পড়ে থাকত, পথে পড়ে থাকত, বাথরুমের পাশে পড়ে থাকত। এদের দেখে একসময় ভাবনায় মোড় ঘুরল। চিন্তা করলাম এ দেশে মানুষের চেহারা সুন্দর করার চেয়ে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা করা বেশি জরুরি। এরপর তাদের নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিলাম। আমার মেয়েও আমাকে এ বিষয়ে অনেক উৎসাহিত করেছে।’
বার্ন ইউনিটের যাত্রা…
এরপর ১৯৮৬ সালে পোড়া রোগীদের জন্য সরকারের কাছে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ তৈরি করার প্রস্তাব দেন সামন্তলাল সেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে বার্ন ইউনিট তৈরির কাজ চলে। ২০০৩ সালে ইউনিটটি উদ্বোধন হয়। তখন পাঁচটি বেড নিয়ে ইউনিট চালু হয়। তবে এখন আরেকটি বড় ইনস্টিটিউট চালু হচ্ছে রাজধানীর চানখাঁরপুলে। চালু হচ্ছে ৫০০ বেডের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট। বললেন, ‘প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ পাঁচ বেড দিয়ে শুরু হলো। যুদ্ধ করতে করতে ৫০, ১০০ , ৩০০, ৫০০ বেড। এর মধ্যে অনেক কষ্ট। আজকে আমার ভালো লাগে, নতুন প্রজন্মের কাজ করার জায়গা রয়েছে। এমনও একদিন গেছে, আমাদের একটি অপারেশন করার জায়গা ছিল না। নতুন ইনস্টিটিউ চালু হলে অনেক রোগীর সেবা দেওয়া যাবে।’
এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে সামান্তলাল সেনকে। তিনি জানালেন, ‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়েছে। অনেকের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। মানে আমি যখন এই ৫০ বেড বানাই, এমনও শুনতে হয়েছে উনি টাকা মেরে কলকাতায় গিয়ে সল্টলেকে বাড়ি বানাবে। নিজেকে খুব অসহায় লাগত। তবে আমি কোথাও যাইনি। এটা আমার দেশ। আমি এ দেশেই থাকব। এই দেশেই মরব।’
বৃক্ষমানব আবুল বাজনদারের ছবি হাতে ডা. সামন্তলাল সেন। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম
বৃক্ষমানব, মুক্তামনির চিকিৎসায় মাইলফলক
সামন্তলাল সেন বলেন, ‘আজকে বার্ন ইউনিটে মুক্তামনি, আবুল বাজনদারদের মতো বিরল রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। এটা বাংলাদেশের মাইলফলক। আমরা এটা করেছি।’
‘এ ছাড়া আপনি দেখেন আমরা যে ইনস্টিটিউট বানাচ্ছি, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট—এই হাসপাতালটি কিন্তু ৫০০ বেডের অত্যন্ত মডার্ন একটি হাসপাতাল হচ্ছে। একদিকে বার্নের চিকিৎসা, আরেকদিকে প্লাস্টিক সার্জারি। এটা তৈরি হলে বহু লোক ভালো চিকিৎসা পাবে।’
‘নতুন চিকিৎসকদের নিয়ে আমি আশাবাদী’
এখন বাংলাদেশে যে ধরনের চিকিৎসা হচ্ছে, আজ থেকে ১০ বছর আগে তেমন চিকিৎসা ছিল না। একটি সময় চিন্তাই করা যেত না এমন চিকিৎসার। বললেন, ‘আমার পরের যে জেনারেশন, এদের মধ্যে মেধা রয়েছে, আন্তরিতা রয়েছে। এই আন্তরিকতা যদি ধরে রাখা যায়, এদের যদি ভালো ফ্যাসিলিটি দেওয়া যায়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের চিকিৎসকরা অনেক ভালো কাজ করবে। ভালো-খারাপ তো সব পেশাতেই রয়েছে। আপনাদের পেশাতেও রয়েছে। ভালো কাজটিকে ফুটিয়ে তোলা দরকার।’
আমাদের দেশে রোগী বেশি, তবে চিকিৎসক কম। প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখ মানুষ আগুনে পুড়ে। তাদের জন্য চিকিৎসক মাত্র ৯২ জন। এ বিষয়ে একটু আক্ষেপ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ডাক্তাররা কী করবে বলুন? ১০০ বেডের হাসপাতালে ৩০০ রোগী। এই রোগী সামাল দিতে তো তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যায়। চিকিৎসক সংখ্যা আরো বাড়ানো দরকার। অন্তত ৪০০ করা দরকার।’
‘মা-বাবার ছবি পকেটে রাখি’
জীবনে যুদ্ধ করেছেন, করছেন অনেক। তবে সফলতাও কম নয়? সামন্তলাল সেন বলেন, ‘এটা হয়তো হয়েছে আমার মা-বাবার আশীর্বাদের কারণে। তাঁদের ছবি সব সময় আমি পকেটে রাখি। তাঁরা আমার জন্য না করলে হয়তো এতদূর আসতাম না। আমি মনে করি, চিকিৎসক হওয়া মানে আসলে ওপরওয়ালার আশীর্বাদ পাওয়া। এ দেশের জন্য আরো ভালো কাজ করে যেতে চাই।’