‘অবিবাহিত কোনো মেয়ে নেই যারা ধর্ষণের শিকার হয়নি’
কক্সবাজারের কলাতলী থেকে একটা পথ চলে গেছে টেকনাফের দিকে। মেরিন ড্রাইভ নামে পরিচিত ওই পথটা পর্যটকদের খুব প্রিয়। বিশেষ করে হিমছড়ি ও ইনানি বিচ দেখতে মানুষের ভীড় জমে। ইনানি বিচকে হাতের ডানে রেখে টেকনাফের দিকে কয়েক কিলোমিটার গেলেই শাপলাপুর গ্রাম।
শাপলাপুর গ্রামের এক পাশে সমূদ্র সৈকত। অন্যপাশে ধানক্ষেত, কিছু বসতবাড়িও আছে। পথেই কোনো গাড়ি থামলে শিশুরা দৌঁড়ে আসছে। কারো গায়ে কাপড় আছে কারো গায়ে কাপড় নেই। আসছে নারীরাও। কোলে নবজাতক। কোনো সময় কাজ হয়। যেমন গাড়ি থেকে দেওয়া হয় চিড়া, মুড়ি, বিস্কুটের প্যাকেট। কেউ পায় কেউ পায় না। গাড়ি চলে যায়। আবার কোনো গাড়ির অপেক্ষা করে তারা।
এরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। এদের অধিকাংশই চলতি সপ্তাহেই মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে। তাদের নৌকা থেমেছে শাপলাপুর গ্রামের সৈকতেই। স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তীরে নেমে আশ্রয় নিয়েছে সড়কের এক পাশে। কেউ খোলা আকাশের নিচে। কেউ শিশু আর বৃদ্ধা-বৃদ্ধর জন্য দুটি বাঁশ পুঁতে কাপড় টানিয়ে দিয়েছে। কোনো মতে সেই কাপড়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে ২০ থেকে ২২ জনের মতো। আবহাওয়াও যে তাদের সহায় না। টানা বৃষ্টি পড়ছে। আবার যেটুকু সময় বৃষ্টি নেই সে সময় পড়ছে রোদ।
স্থানীয় বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ এনটিভি অনলাইনকে জানান, ঈদের পর থেকে টেকনাফের মতো ওই এলাকা (শাপলাপুর) দিয়েও নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে মেরিন ড্রাইভের ওই এলাকায়।
নূর মোহাম্মদ জানালেন, ভোরের দিকে চোখে পড়ে নৌকায় করে মানুষ আসছে। নৌকায় তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এসব মানুষের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যাই বেশি। নৌকা থেকে যখন এরা নামে নারীদের কোলে থাকে শিশু আর বৃদ্ধদের হাত ধরে রাখে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সি শিশুরা। এরা সবাই বলতে গেলে এক কাপড়েই এ দেশে চলে এসেছে। বেশির ভাগ মানুষের কাছে কোনো ব্যাগ বা পুটলি নেই। বোঝাই যায়, কোনোমতে প্রাণ নিয়ে বেঁচে এসেছে তারা।
স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই রোহিঙ্গাদের। কিন্তু ভাষা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। এ সময় সাহায্য নেওয়া হয় স্থানীয় বাসিন্দাদেরই।
দিল মোহাম্মদ, রসুলসহ একাধিক বায়োজ্যেষ্ঠ রোহিঙ্গা ব্যক্তির সঙ্গে কথা হল। তাঁরা দুইদিন ধরে এ এলাকায় আছেন। স্বজনদের নিয়ে জীবনবাজি রেখে বাংলাদেশে এসেছেন। এসব বৃদ্ধ মানুষ নিজেদের একাধিক ছেলে হারিয়েছেন। মিয়ানমারে তাঁদের কারো গ্রামের নাম মেরুল্লা, কারো গ্রামের নাম রাসিদং।
দিল মোহাম্মদ বলেন, মিয়ানমারের পুলিশ, সেনাসদস্য, সীমান্তরক্ষী বাহিনী এবং বেসামরিক মানুষরা মিলে খুনের নেশা মেতে উঠেছে। নির্বিচারে গুলি করা হচ্ছে। গুলি করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না তারা, গলা কেটে তা শরীর থেকে আলাদা করে ফেলছে। হামলার কোনো দিন-রাত নেই।
মোহাম্মদ রসুল জানালেন, হামলার ভয়ে মানুষ মূড়ায় (পাহাড়ি বন) গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখানেও মুক্তি নেই। নির্বিচারে গুলি করা হয়। বনেও লাশ পাওয়া যায় রোহিঙ্গাদের।
দেশ ছেড়ে তরুণ আর তরুণী রোহিঙ্গারা আসে না? ওরা কোথায়? ষাটোর্ধ রহিম উল্লাহ বলেন, ওদের বাঁচিয়ে রাখলে তো! হামলা হলে সবার আগে মারা হয় তরুণ ও যুবকদের। গুলি করে থেমে থাকে না, মৃত শরীরটাকে নিয়েও যাচ্ছেতাই করে ওরা। আর তরুনী? অবিবাহিত কোনো মেয়ে নেই যারা ধর্ষণের শিকার হয়নি। ধর্ষণের পর ওদের বাঁচিয়ে রাখে না তারা। গলা কেটে হত্যা করে।
সলিমুল্লাহর বয়স ৬৫ হবে। এসব কথা শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। তাঁর দাবি, তাঁর দুই ছেলেকে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সেনারা। তিনি জানালেন, তিনি এমন দৃশ্য দেখেছেন যা ভাবলেও তিনি ঘুমাতে পারেন না। সেটা কী? জানতে চাইলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ‘একটা মাঠের কোনায় কেবল মানুষের কাটা মাথা স্তূপ করে রাখা হয়। গলা কেটে এনে মাথাটা ফেলা হয় ওই স্তূপে। স্তূপটা একসময় অনেক বড় হয়।’
সলিমুল্লাহর চোখের পাতা পড়ছিল না। একনজরে তাকিয়ে ছিলেন। দেশে বাড়িঘর, জমি আছে। আবার সব ঠিক হলে ফিরবেন না? তিনি বললেন, ‘যা দেখলাম, কীভাবে বলি সব ঠিক হয়ে যাবে? কীভাবে বলি আবার শান্তি আসবে?’