এখন তাঁরা নিঃস্ব
সাদা মাইক্রোবাস এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে শিশু, নারী আর কয়েকজন বৃদ্ধ মানুষ ধাক্কাধাক্কি করা শুরু করল। কার আগে কে যাবে। গাড়ি থেকে কিছু খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়। সেটা নিয়ে শুরু হয় রীতিমতো যুদ্ধ। যে পারে তার ভাগ্যে জুটে ওই প্যাকেট। আর যে পারে না, সে বাদ।
মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যেতে মাঝেই পড়ে ইনানি বিচ। এর পরই একটি গ্রামের নাম শাপলাপুর। গ্রামের এক পাশে সমূদ্র। অন্যপাশে খোলা আকাশের নিচে আছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শতাধিক পরিবার।
এসব পরিবারের খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি পর্যায়ে কেউ যদি মনে করে তবে গিয়ে কিছু খাবারের প্যাকেট দিয়ে আসে। তাই খেয়ে ভরছে সেখানকার নারী, শিশু আর বৃদ্ধদের পেট।
আজ রোববার বিকেলে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থানের পর এসব দৃশ্য চোখে পড়ল। রাস্তায় গাড়ির প্রতীক্ষা করছে মানুষ। এলেই হুড়াহুড়ি।
পাশেই চোখে পড়ল এক ব্যতিক্রম দৃশ্য। সাদা আলখাল্লা পরা এক ষাটোর্ধ লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব দৃশ্য দেখছেন। আলখাল্লাটা ময়লা। মুখে সাদা দাঁড়ি। বুক পকেটে চশমার কভার। কিন্তু চোখে চশমা নেই। হাতের অন্য কোথাও কোনো চশমা নজরে পড়ল না।
আরিফ নামে স্থানীয় এক যুবক ছিলেন পাশে। ‘আচ্ছা ওই ভদ্রলোক কি রোহিঙ্গা?’
আরিফ জানালেন, হ্যাঁ তিনি রোহিঙ্গা। গত পরশু পরিবার নিয়ে শাপলাপুর গ্রামেই নৌকা থেকে নেমেছেন। তবে তিনি ত্রাণ বা সাহায্যের জন্য ছোটাছুটি করেন না। এসব সাহায্য এলে তিনি এক পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন। কিছু চান না বলে কিছু পানও না।
ষাটোর্ধ ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ রহিম উল্লাহ। মিয়ানমারে তাঁর গ্রামের নাম মেরুল্লা। তিনি জানান, তিনি বেশ অবস্থাপন্ন কৃষক ছিলেন। ওই গ্রামে তিনি ১৮ কানি জমির মালিক। কানি জমি পরিমাপের একক। তবে তা আঞ্চলিকভাবে প্রচলিত। বাংলাদেশেও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে জমি পরিমাপের বেলায় কানি শব্দটি ব্যবহার করে মানুষ। এসব এলাকায় ৪০ শতকে এক কানি। আবার ৩৩ শতকে এক বিঘা।
রহিম উল্লাহ জানালেন, ১০টা গরু ও ১৫টি ছাগল ছিল। তাঁর পরিবারটা অবশ্য বেশ বড়। স্ত্রী ও সন্তানসহ ১৫ জনের পরিবার। চাষাবাদ করে ভালোই চলছিল। তবে এখন তিনি নিঃস্ব। পরনের পোশাকটা পরে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন। এর আগে ঘটেছে অনেক দুঃসহ ঘটনা। তাঁর দুই মেয়েকে মেরে ফেলেছে মিয়ানমারের সেনারা। এক মেয়ের কোনো খোঁজ নেই। প্রাণ বাঁচাতে পাঁচদিন ছিলেন পাহাড়ের বনে। এরপর রাতের অন্ধকারে তিনদিন ধরে হেঁটেছেন পরিবারকে নিয়ে।
রহিম জানান, নাফ নদী পেরিয়ে শাপলাপুর নেমেছেন। পকেটে যা ছিল সব চলে যায় নৌকার খরচে। প্রতি সদস্যের জন্য দালালকে তিন হাজার করে টাকা দিতে হয়েছে। কিন্তু এখন আর কিছুই নেই। কেবল প্রাণটা বাঁচানোর জন্য এখানে চলে এসেছেন।
সাহায্যের জন্য সবাই ছোটাছুটি করে কিন্তু আপনি যান না? রহিম উল্লাহ মাথাটা একটু উঁচু করেন। জানান, এভাবে কখনো সাহায্য নেননি তিনি।
কেবল রহিম উল্লাহ না, শাপলাপুরে মিলেছে একাধিক রোহিঙ্গা, যারা বেশ অবস্থাপন্ন ছিলেন। এমনই একজন দিল মোহাম্মদ। তাঁর গ্রামের নাম নয়ামানপাড়া। তিনি জানালেন, তাঁর পাঁচ কানি জমি আছে। তিনটি গরু ছিল। এখন কিছু নেই। কেবল নিজের পরনের জামাটা আছে।
রাসিডং গ্রামের মেয়ে ফাতেমা বেগম। বয়স পঁয়ত্রিশের মতো হবে। পরনের শাড়িটা কুঁচকে আছে। বোঝাই যায় একাধিকবার ভিজেছে আবার শুকিয়েছে। কিন্তু এরপরেও শাড়িটায় একটা আভিজাত্য বোঝা যায়।
ফাতেমা জানালেন, তিনি তিন সন্তানের মা। স্বামী নিখোঁজ। প্রাণ বাঁচাতে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। তাঁর স্বামী বেশ অবস্থাপন্ন কৃষক ছিলেন। তিনি ওই গ্রামে ৪৮ কানি জমির মালিক। ১২টা গরু ছিল তাঁদের। ছাগলও ছিল ১০টির মতো। মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গরু-ছাগল লুট করে নিয়ে যায়।
ফাতেমার কোলের শিশুটির বয়স সাড়ে তিন বছর, আর অন্য দুটির একটির বয়স পাঁচ, অন্যটির আট। কোনো মতে এক কাপড়ে চলে এসেছেন বাংলাদেশে। সামনে কী হবে কিছুই জানেন না তিনি।
কথা বলতে বলতে একটি মাইক্রোবাস দেখা গেল। সবাই ছুটল ওদিকে। ফাতেমা বেগম ছুটলেন না। তাঁর শিশুরাও গেল না।