‘ওই মৃত্যুর দেশে আর ফিরব না’
উখিয়া উপজেলা এখন কক্সবাজারের ব্যস্ততম এলাকা। উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম পালংখালী। পাহাড়, বন আর সাগর পাড়ের এ এলাকায় এখন প্রচুর ভিড়। কুতুপালংয়ের পর বালুখালীতে আরেকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প করা হয়েছে। বালুখালী পড়েছে পালংখালী ইউনিয়নে।
বালুখালী গেলেই চোখে পড়বে টেকনাফের সড়ক দিয়ে আসছে রোহিঙ্গা পরিবার। এসব পরিবারের আসার পথ খুঁজতে গিয়েই পাওয়া গেল ইউনিয়নের একটি ছোট্ট গ্রাম আনজুমান পাড়া। এ পাড়ায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি ক্যাম্পও আছে।
গ্রামটির এক পাশে সবুজ ধানক্ষেত। এরপরই নাফ নদী। আর নাফ নদীর পরেই চোখে পড়ে পাহাড়। স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গারা এ পাহাড়ের নাম দিয়েছে কালাপাহাড়। স্থানীয় বাসিন্দা লুৎফুর রহমান জানালেন, ওই পাহাড়ই এখন রোহিঙ্গাদের কাছে আতঙ্কের আরেক নাম। লুৎফুর বলেন, ‘ঈদের সময়, ঈদের পরে আমরা দেখেছি ওই পাহাড়ে ধোঁয়া উড়ছে। গ্রাম যে জ্বলছে তা এখান থেকেই বোঝা যায়।’
সবুজ ধানক্ষেতে চোখ পড়তেই দেখা গেল আইলের মাঝ দিয়ে আসা মানুষের সারি। বেশ লম্বা লম্বা সারি। একটু এগোতেই চোখে পড়ল শিশুরা হাঁটছে, নারীরা হাঁটছে। যুবক আছে হাতে গোনা কয়েকজন। আছে বৃদ্ধরাও। লাঠিতে কাপড় টানিয়ে তাতে ঝুলিয়ে আনা হচ্ছে বৃদ্ধদের।
বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, জলাভূমিতে কোনো গাছ নেই। সোমবার দেখা গেল, দুপুরের গনগনে রোদে আইল ধরে রোহিঙ্গারা আনজুমান পাড়ায় ঢুকছে।
রোহিঙ্গাদের হাঁটা শেষ হয় যেখানে, সেখানে গিয়ে দেখা গেল প্রায় ২০ থেকে ২৫টি পরিবার বসে আছে। এরা ঘণ্টাখানেক আগে এখানে এসেছে। নারী, শিশুরা বিশ্রাম করছে। এদের কাছে ব্যাগ আছে, আছে বিভিন্ন ধরনের পুঁটলি।
মোহাম্মদ ফারুক নামে এক রোহিঙ্গা পথ দিয়ে মাত্র এলেন। বয়স ৩৫ হবে। কোলে এক শিশু। উঁচু পথে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে দিলেন স্থানীয় একজন। পথে উঠে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। দরদর করে ঘাম ঝরছে। পড়ছে চোখ দিয়ে পানিও। বললেন, ‘ভাইরে, কতকিছু ছিল। জমিজমা, দোকানপাট, গরু ছাগল। সব ফেলে চলে এসেছি। গায়ের কাপড়টাও আরেকজনের। নদী, খাল পার হয়ে আসতে হয়। সব ভিজে নষ্ট হয়েছে।’
ফারুকের সঙ্গে আছে তাঁর স্ত্রী, বোন, মা আর দুই শিশু। সঙ্গে অন্য স্বজনরাও আছে। তবে বাবাকে আনেননি। তাহলে আপনার বাবা কীভাবে থাকবে সেখানে? ফারুক বলেন, ‘তিনি অনেক বয়স্ক। হাঁটতে পারেন না। আনতে হলে আরো দুইজন জোগাড় করতে হবে। যারা লাঠিতে করে ঝুলিয়ে আনবে তাঁকে। কিন্তু সেই সময় কোথায়? সেই টাকাপয়সাও কোথায়?’
আপনার বাবা একা কীভাবে এ অবস্থায় থাকবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, ‘নিজেরা বেঁচে এসেছি। বাঁচব যে সে অবস্থাও ছিল না। এখন দেখি বাবাকে কীভাবে আনা যায় সে চিন্তা করব। তাও সম্ভব কি না জানি না।’
মিয়ানমারে ফারুকের গ্রামের নাম বুচিডং। কৃষিকাজ করতেন তবে তাঁর একটি ওষুধের দোকান ছিল। তিনি জানান, আজ থেকে ১০ দিন আগে ওই গ্রামটি জ্বালিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ফারুক জানালেন, সেনারা ও মগ (সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের রোহিঙ্গারা মগই বলছে) একবার এসে সতর্ক করে যায়, যার ভাষাটা এমন, তোমরা এ দেশের না। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে যাও। এর পরদিন এসেই জ্বালিয়ে দেয় গ্রাম। পাখির মতো মানুষ মারতে থাকে। মানুষ তখন কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালায়।
পালিয়ে রোহিঙ্গারা প্রথমে চলে যায় মূড়ায় (পাহাড়ের বন)। সেখানে আরো কয়েক পরিবার একত্রিত হয়ে হাঁটা শুরু করে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে। ফারুক জানালেন, চারদিন ধরে হাঁটছেন তাঁরা। পথে পড়েছে দুইটা খাল আর একটা নদী। চারদিন পর দেখা পেলেন আনজুমানপাড়ার। মিয়ানমারের ভেতরে দিনের আলোতেও হাঁটতে পারেননি আতঙ্কে।
ফারুক আর তাঁর পরিবারকে পানি দিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কেউ চিড়ার প্যাকেট ও কলা তুলে দিল তাঁদের হাতে। শিশুরা ক্লান্ত, চোখ মুখ থেকে আতঙ্ক যাচ্ছে না। এখন কী করবেন জানতে চাইলে ফারুক বলেন, ‘জানে বাঁচলাম। এখন দেখি এখানে কী করতে পারি।’
দেশে যাবেন? প্রশ্ন শুনে ফারুক প্রবল বেগে মাথা নাড়ালেন। বললেন, ‘না, ভাই ওই মৃত্যুর দেশে আর ফিরব না।’
এরই মধ্যে আগে আসা কয়েকটি পরিবার উঠে দাঁড়াল। বিশ্রাম হয়েছে। স্থানীয় এক লোক এসে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি মিয়ানমারের নোট কিয়াত নিচ্ছেন বিনিময়ে বাংলাদেশি টাকা দিচ্ছেন। স্থানীয় কয়েকজনই জানাল, অনেক কম রেটে টাকা ভাঙাচ্ছে রোহিঙ্গারা। কিছু করার নেই। কারণ ওদের টাকা প্রয়োজন।
এরই মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন চলে এসেছেন। নির্দেশনা দিচ্ছেন কোথায় যেতে পারবে তারা। রোহিঙ্গাদের অনেকেই হেঁটেই ক্যাম্পে যাওয়ার কথা জানাল। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালীরা জানালেন, যেতে হবে ছোট আকারের ট্রাকে করে। আর এসব ট্রাকে উঠতে গেলেই গুনতে হবে টাকা। একাধিক পরিবার ভ্যানে ওঠে। যারা পারে না তারা পথেই বসে থাকে। কেউ টেকনাফ সড়কের দিকে হেঁটে রওনা দেয়। ওরা শুনেছে টেকনাফ সড়কে যেতে পারলে নাকি সহযোগিতা পাওয়া যাবে।
বালুখালী ক্যাম্পের সামনের সড়কে গিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট ট্রাক থামছে। আর সেখান থেকে নামছে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। একটি ট্রাকের চালক মজিদ মিয়া জানালেন, জনপ্রতি এক হাজার ২০০ টাকা করে নিয়েছেন তিনি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এভাবে রোহিঙ্গাদের এসব ক্যাম্পে আনছেন।
ক্যাম্পে পৌঁছলেই কাপড় টানানো ঘর মিলছে না। বসে থাকতে হচ্ছে পথে। বালুখালীর পাহাড়ের ওপরে করা হয়েছে ক্যাম্প। পাহাড়ের নিচে শত শত পরিবার বসে আছে। এরা গত দুদিনের মধ্যে এখানে এসেছে।
আরেফ নামে এক রোহিঙ্গা শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখানে কেন? প্রশ্নের জবাবে আরেফ বললেন, ‘খাবারের গাড়ি আসবে। খাব।’
বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি ট্রাক ও মাইক্রোবাস বালুখালী ক্যাম্পের পাশে এসে দাঁড়ায়। আর তাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে নারী ও শিশুরা। রুটি বা বিস্কুট হাতে পেলেই আনন্দে চিৎকার করে। আরেফ বলেন, ‘কী করব ভাই, ঠিকমতো খেতেই পারছি না।’