চারজন এসে মেরে ফেলে বাবা-মেয়েকে!
রাজধানীর উত্তর বাড্ডার ভাড়া বাসায় গতকাল বুধবার গভীর রাতে বাবা-মেয়েকে হত্যা করে চার ব্যক্তি। বাড়িওয়ালি নাসিমা দুলালের কাছে এমনটিই দাবি করেছেন নিহত গাড়িচালক জামিলের স্ত্রী আর্জিনা খাতুন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আর্জিনাকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আরজিনা জানান, জামিলের কিছু পরিচিত মানুষ টাকার লেনদেনের বিষয়ে কিছুদিন থেকে তাকে হুমকি দিচ্ছিল। গতকাল রাতে চারজন বাসায় এসে তাঁর স্বামী-মেয়েকে হত্যা করে। তাদের তিনি চেনেন না। টাকা নিয়ে জামিলের সঙ্গে অনেকের শত্রুতা ছিল।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে উত্তর বাড্ডার ৩০৬ ময়নারবাগ পাঠানবাড়ী কবরস্থানের মসজিদসংলগ্ন একটি বাড়ি থেকে জামিল (৩৮) ও তাঁর মেয়ে নুসরাতের (৯) লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনতলা বাড়ির ছাদের একটি রুম ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকতেন জামিল। এই কক্ষে জামিলকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া গেলেও মেয়ে নুসরাতের শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পায়নি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। সার্বিক অবস্থা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, নুসরাতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই বাসায় গেলে কথা হয় বাড়ির দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া জ্যোস্না বেগমের সঙ্গে। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৬টার দিকে কান্নার শব্দ পাইয়া সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠে যাই, উপরে গিয়া দেখি আর্জিনা দরজার সামনে হেলান দিয়া বসে আস্তে আস্তে কান্নাকাটি করছে। আমি কইলাম, ওই কি হইছে। হে তখন কয়, ঘরে চারজন ডাকাত আইছিল, নুসরাতের বাপরে মাইরা ফালাইছে।’
‘যখন শুনলাম নুসরাতের বাপেরে মাইরা ফালাইছে, তখন দরজা দিয়া ভিতরে তাকাইয়া দেখি খাটের উপরে বাপ-বেটি মইরা পড়ে আছে। এরপর আমি জলদি বাড়িওয়ালিকে ডাকতে যাই। বাড়িওয়ালি আসার পরে আমরা ঘরে ঢুকে দেখি জামিলের মুখের ওপরে একটা কাপড় দেওয়া। তখন বিছানার কাপড়টা টান দিতেই দেখি রক্ত। এরপর জোরে চিৎকার মারে বাড়িওয়ালি। তারপর সবাই উপরে চলে আসে।’
জ্যোস্না বেগম আরো বলেন, তারা যখন ঘরে ঢুকে লাশ দেখে চিৎকার দিয়েছিল তখন সাড়ে তিন বছর বয়সী শিশু আলপিন বাবার পায়ের কাছে বসে কাঁদছিল। এরপর পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে আর্জিনা ও আলপিনকেও থানায় নিয়ে যায়।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাড়ির মালিকের স্ত্রী নাসিমা দুলাল এনটিভি অনলাইনকে জানান, জ্যোস্না বেগমের কাছ থেকে এই খবর শুনে তিনি দৌঁড়ে ছাদের উপরে গিয়ে দেখেন জামিলের স্ত্রী আর্জিনা মুখের উপরে ওড়না দিয়ে বসে কান্নাকাটি করছে। এরপর ঘরে গিয়ে জামিল ও তাঁর মেয়ের লাশ দেখতে পেয়ে ভয়ে চিৎকার করেন তিনি। তাঁর চিৎকারের ফলেই আশপাশের মানুষ ছুটে আসে।
নাসিমা দুলাল আরো বলেন, যখন তিনি আর্জিনার কাছে জানতে চান এ সব কীভাবে হলো? তখন আর্জিনা বলেন, রাতে চারজন ডাকাত আসছিল। তারাই তাঁর স্বামী আর মেয়েকে মেরে ফেলেছে।
কিন্তু এত কিছু হওয়ার পরও আর্জিনা কেন কাউকে ডাকাডাকি করেননি-জানতে চাইলে তেমন কোনো উত্তর দেয়নি আর্জিনা। শুধু বলেছে, ডাকাতরা তাঁর হাত-পা ও মুখ বেঁধে রেখেছিল।
স্থানীয় লোকজন জানান, জামিল পেশায় একজন চালক। তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ওই এলাকায় ভাড়া থাকেন। তবে এই বাসায় তিনি মাত্র এক মাস ধরে থাকছেন। জামিলের মেয়ে নুসরাতের বয়স নয় বছর। নুসরাত স্থানীয় একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। আর ছোট ছেলের নাম আলপিন। তাঁর বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর।
সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটের সিনিয়র এএসপি আবদুস সালাম বলেন, ‘বাবার মাথায় ৬টার মতো আঘাত আছে। এগুলো চাপাতির আঘাত হতে পারে। ভারী ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। সে কারণেই হয়তো মৃত্যু হয়েছে। মেয়েকে হত্যার ভিজিবল কোনো সাইন পাওয়া যায়নি। হতে পারে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে।’
এদিকে বাড়ির ছাদে অন্য রুমে জামিলের দেওয়া সাবলেটে এক যুবক থাকতেন। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন জানিয়ে পুলিশ বলছে, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে।
পুলিশের বাড্ডা জোনের সহকারী কমিশনার মো. আশরাফুল করিম বলেন, ‘আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আগাচ্ছি। তাদের মধ্যে পারিবারিক কোনো সমস্যা ছিল কি না, কোনো পূর্ব শত্রুতা ছিল কি না, অনেক ক্লু নিয়ে আগাচ্ছি। তদন্ত চলছে। বাসায় সম্ভবত কেউ আসছে। আসার পর বের হয়ে গেছে।’
এ ব্যাপারে বাড়িওয়ালি নাসিমা দুলাল বলেন, ‘রাত ১০টার পর বাড়ির গেট লাগানো থাকে। বাইরের কোনো লোক আসতে পারে না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) কৃষ্ণপদ রায় জানান, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে পারিবারিক কোনো দ্বন্দ্ব আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ জন্য নিহত জামিলের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।
স্ত্রীকে সন্দেহ করার কারণ জানতে চাইলে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, কারণ জামিলের স্ত্রীর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাই ধারণা করা হচ্ছে, ঘরের ভেতর থেকে কেউ খুনিকে সহযোগিতা করেছে। তা না হলে এভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না। এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই তাঁকে আটক করা হয়েছে।
জামিল ও তাঁর মেয়ে নুসরাতের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।