রিভিউ
‘ডুব’ নিয়ে বিভক্তি
‘আমার ছবি মুক্তি পাবে, আর জাতি দুই ভাগে বিভক্ত হবে না; সেটা তো হয় না’—এই কথা ফারুকীর। মানে নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর। এই কথা কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো না। সেই ‘ব্যাচেলর’ থেকে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’, ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ কিংবা ‘টেলিভিশন’ অথবা ‘পিঁপড়া বিদ্যা’—সবগুলো ছবি মুক্তির পর বহু কথা হয়েছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে পাঁচতারা হোটেলের বারে তর্ক হয়েছে। কেউ বলেছে ‘অসাধারণ’, কেউ বলেছে, ‘ছবির জাতও হয় নাই’।
‘ডুব’ ছবিটার সঙ্গে আগের ছবিগুলোর মৌলিক তফাত হলো, আগেরগুলো মুক্তির পর জাতি বিভক্ত হয়েছিল। আর ‘ডুব’-এর কপালে মুক্তির আগেই তির্যক সমালোচনা ও প্রশংসা দুটোই জুটে গেছে। বিতর্কের বিষয় হুমায়ূন আহমেদ। বাকিটা না বললেও চলবে। হলে গিয়ে ছবিটা দেখতে যেতে এ বিষয়গুলোও আমাকে প্ররোচিত করেছে।
হলে ঢোকার সময়ই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি, হুমায়ূন নামের দুজন লোককেই আমি সারা জীবনে চিনেছি। একজন হলেন, মোগলসম্রাট জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবুরের ছেলে নাসিরউদ্দিন মুহাম্মাদ হুমায়ূন। আরেকজন হলেন, আমার জেলা শহরের মিষ্টির দোকানদার হুমায়ূন মোল্লা ওরফে হুমায়ূন কাকা। হুমায়ূন কাকা ভারি সুন্দর রসগোল্লা বানাতেন। ছোটবেলায় আব্বাকে বলতাম, ‘আসার সুমায় এক কেজি হুমায়ূন মিষ্টি আইনো।’
যাক, হুমায়ূন মিষ্টি বিজড়িত শৈশব স্মৃতি বাদ দিয়ে চলেন ছবি দেখি—
ছবির শুরুতে দেখা গেল দুই তরুণী একটা অনুষ্ঠানে এসেছে। অস্বস্তি নিয়ে তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। একজনের নাম নিতু। একজনের নাম সাবেরি।
একটা দুটো বাক-নির্বাক সংলাপের পর এক টানে ফারুকী আমেদের ফ্ল্যাশব্যাকে নিয়ে গেলেন।
গল্প গড়াতে লাগল। আমরা জানলাম, কেন্দ্রীয় চরিত্র জাভেদ হাসান (ইরফান খান) অসম্ভব জনপ্রিয় একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। ক্যারিয়ারের গোড়াতে তিনি মায়া (রোকেয়া প্রাচী) নামের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। মায়ার বাবা মায়াকে জাভেদের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। তবু বিয়ে হলো। দিন গড়াল। তাঁদের একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে হলো। মেয়ের নাম সাবেরি (নুসরাত ইমরোজ তিশা)। আর ছেলের নাম আহির (রাশাদ হোসেন)। সাবেরির ক্লাস ফ্রেন্ড নিতু (পার্নো মিত্র) সাবেরির সঙ্গে পড়াশোনা থেকে শুরু করে আর্ট কালচার—কোথাও পেরে ওঠে না। সেই নিতুকে অভিনয়ে আনেন জাভেদ হাসান। নিতু তারকা খ্যাতি পায়। কন্যার বান্ধবী নিতুর সঙ্গে জাভেদের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। নিতু সে কথা পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলে দেয়। এই নিয়ে জাভেদের সঙ্গে তার স্ত্রী-ছেলে মেয়ের মানসিক টানাপড়েন শুরু হয়। জাভেদ তাঁর নিজের বাসা থেকে নিরিবিলিতে থাকার জন্য তাঁর বাংলো বাড়ি ‘নয়নতারা’তে এসে ওঠেন। নিতুকে নিষেধ করার পরও সে রাতে সন্তর্পণে দেয়াল টপকে ‘নয়নতারা’য় চলে আসে। জাভেদ উপেক্ষা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। একপর্যায়ে নিতুকে বিয়ে করেন জাভেদ। দুঃখে ও অপমানে ছেলে মেয়েদের নিয়ে মায়া বাড়ি ছেড়ে চলে যান। সেই বাড়িতে ওঠে নিতু।
নিতুকে বিয়ে করলেও প্রথম স্ত্রী মায়া এবং বিশেষ করে সন্তানদের জন্য জাভেদের মধ্যে মানসিক যন্ত্রণা শুরু হয়। সাবেরি তার বাবা জাভেদকে বলে যায়, নিতু কোনো দিন তার সঙ্গে কোনো কমপিটিশনে পারেনি। সেই ক্ষোভ থেকে নিতু প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে সাবেরির বাবাকে বিয়ে করেছে। খুব কম সংলাপ ব্যবহার করে ডকুমেন্টারিধর্মী প্রলম্বিত কিছু দৃশ্য চলতে থাকে। আমরা বুঝতে পারি জাভেদের ভেতরে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।
একটা ঠান্ডা দৃশ্যে আমরা দেখি জাভেদ নিতুর দিকে অতি আবেগে ঝুঁকে আসেন। তাকে জড়িয়ে ধরেন। দৃশ্য কাট না করে ক্যামেরা প্যান করে পাশের একটা রুমে ধরা হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন তালবে এলেম মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কোরআন পড়ছে।
বোঝা যায়, জাভেদ মারা গেছেন। এখানে হয়তো ছবির শেষ হতে পারত। কিন্তু তা হয় না। লাশ কোথায় দাফন হবে, তা নিয়ে পারিবারিক ঝামেলা তৈরি হয়। নিতুর ইচ্ছে, জাভেদকে ‘নয়নতারা’তে দাফন করতে হবে। সাবেরিরা রাজি হয় না। শেষ পর্যন্ত ‘নয়নতারা’ নামে জাভেদের যে শুটিং স্পট ছিল, সেখানেই কবর হয়। এখানেই প্রেমিক জাভেদের যাত্রা শেষ হয়। গল্প ফ্ল্যাশব্যাক থেকে আবার সেই প্রথম দৃশ্যের দুই তরুণী মিতু ও সাবেরি সামনে দাঁড়ায়। ছবি শেষ হয়।
ছবির এই গল্প সাদামাটা। খুব নাটকীয় কিছু নেই। তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা, ফিল্মি ভাষায় যাকে ক্লাইমেক্স বলে তা এ ছবিতে নেই। ঠান্ডা এবং মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলা একটা গল্প এখানে আছে। আর আছে দারুণ একটা চিরায়ত দর্শন।
ছবির শুরুর দিকের একটি দৃশ্যে দেখা যায়, জাভেদ তাঁর মেয়েকে বলেন, মানুষ মারা যায় তখনই যখন প্রিয়জনের সঙ্গে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়। প্রিয়জনের কথা শোনার, তাঁদের দেখার আকাঙ্ক্ষা কিংবা ক্ষমতা যখন সে হারিয়ে ফেলে তখন সে পৃথিবীতে থাকার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে। জাভেদের মৃত্যুর পর আমরা বুঝতে পারি, স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হওয়ার কারণেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছে। এই যোগাযোগহীনতাই এই করপোরেট সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট। একই সঙ্গে মৃত্যু এমন এক স্নিগ্ধ টনিক, যা দূরে যাওয়া স্বজনকে নিমেষেই কাছে নিয়ে আসে।
জাভেদের মৃত্যুর পর তাঁর প্রথম স্ত্রী মায়া স্বগতোক্তি বলেন, এই মৃত্যুতে তিনি কষ্ট পাননি। জাভেদের মৃত্যু তাঁকে জাভেদের কাছে এনেছে। জীবিত জাভেদের কাছে যাওয়ার পথে নিতু বাধা হয়েছিল। কিন্তু এখন নিতুর আর সেই সাধ্য নেই। জাভেদকে মায়া এখন তাঁর সত্তায় আপন করে নিতে পারছেন।
যাঁরা ফারুকীর আগের ছবিগুলো দেখেছেন, তাঁরা একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন আগের সবগুলো ছবির সঙ্গে এটির মৌলিক পার্থক্য আছে। সম্ভবত এটি ফারুকীর সবচেয়ে পরিণত সৃষ্টি। এখানে গল্পটা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় ফারুকীকে আগের ছবিগুলোর মতো ‘অসৎ’ হতে দেখা যায়নি।
আমরা বুঝতে পারি কিংবা বলা যায় আন্দাজ করতে পারি, ফারুকী শুধু বাংলাদেশি দর্শকের কথা মাথায় রেখে ছবি বানান না। আমার আন্দাজ (ভুল হতেও পারে), বিশ্বের বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল এবং সেখানকার জুরিদের কাছে কোন বিষয়গুলো উপাদেয় হবে তা ফারুকী আগেভাগেই মাথায় রাখেন। স্ক্রিপটিং সেভাবেই হয়।
‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’ ছবির লিভ টুগেদারকে এমনি এমনি খুব স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা আমাকে পিটিয়ে মেরে ফেললেও বিশ্বাস করব না। বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজে এই বিষয়ের সাবলীল উপস্থাপনকে বাইরের দেশগুলো ফারুকীর ‘সাহসী’ ভূমিকা হিসেবে দেখবে এবং অ্যাওয়ার্ড হান্টিংয়ে বিষয়টি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে—এটা ফারুকী বোঝেন। আফগানিস্তানের পশ্চাৎপদ সমাজের দৃশ্যায়ন করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার লুফে নিয়েছেন অনেকেই। সেই পথে হেঁটে ফারুকী ‘টেলিভিশন’ ছবিতে বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ চেহারা তুলে ধরেছেন বলেও সন্দেহ করি। একইভাবে তাঁর প্রথম ছবি ‘ব্যাচেলর’-এর ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ও সেই উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি।
কিন্তু ‘ডুব’ ছবিটায় মনে হলো সেই ‘বদ মতলব’ একেবারেই নেই। এই গল্পের মধ্যে একটা চিরায়ত দর্শন প্রতিষ্ঠার দুর্নিবার চেষ্টা আছে। স্বজনদের পারস্পরিক বন্ধন এবং মৃত্যুর অমোঘ সুন্দর ক্ষমতা সম্পর্কে এখানে মেসেজ রাখা হয়েছে। অ্যাওয়ার্ড হান্টিংয়ের স্থূল চেষ্টা নেই।
আরেকটি দিক হলো, আমি কিরে কসম কেটে বলেছিলাম হুমায়ূন আহমেদ নামের কাউকে আমি চিনি না। শাওনকে সেই খবরও আমার জানার দরকার নেই। কিন্তু একটি দৃশ্য একমুহূর্তের জন্য আমাকে এই দুজনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল : জাভেদ নিতুকে বিয়ে করার পর একটি টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে যান। সেখানে এক দর্শক টেলিফোন করে তাঁকে, ‘আপনার পাশের ওই মেয়েটা কে? সে আপনাকে ধ্বংস করে দেবে। সে অ্যাটেনশন সিকার’—এই ধরনের কথা বলতে থাকেন। এই সময়ে কেন যে হুমায়ূন আহমেদ এবং শাওনের কথা মনে হলো, ধরতে পারছি না।
তবে যদি ধরেও নিই, এটি হুমায়ূনের বায়োপিক, তাহলেও এটি দর্শক হিসেবে আমার কাছে অস্বস্তিকর মনে হবে না। আমার মতো নিশ্চয়ই আরো অনেকে আছেন। আবার উল্টোটাও আছে। অনেকেই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এটি হুমায়ূনের বায়োপিক।
ফলে পক্ষ দুটোই দাঁড়াল। জাতি দুই ভাগ হলো। ফারুকীর কথা সত্যি হলো।