২০১৮
ভালোবাসার বছর
শৈশবে ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে চলেছি। বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে অসংখ্য ক্যালেন্ডার টাঙানো থাকত। সবকটির ছবিই যে পছন্দ হতো, তাই নয়। একটির হয়তো দুটি পাতা, অন্য কোনোটির একটি, এভাবে বারো মাসে বারোটি পছন্দের পাতা থাকত আমার। একেক মাসে একেক ক্যালেন্ডারের দিন গুনে এগিয়ে গেছি। শেষ পাতাটিতে এসে চঞ্চলতা বেড়ে যেত। পরের যে পাতাটি আসছে, সেটি কেমন হবে, এবার কতগুলো ক্যালেন্ডার দেয়ালে উঠবে। যে সময়টি বা বছর চলে গেল, তা নিয়ে খুব একটা হাহাকার উঠত না মনে। বরং নতুন বছরে যাচ্ছি, সেইসঙ্গে তো একটু বড়ও হচ্ছি। সুতরাং নতুনকে আনন্দে বরণ করতে উদগ্রীব থাকতাম। শুধু কি ক্যালেন্ডারের পাতা? নতুন বইও তো আসত ঘরে।
নতুন ক্লাসে ওঠা, সঙ্গে নতুন বই-খাতার ম-ম ঘ্রাণ। টেবিলে-বিছানায় ছড়ানো নতুন বই-খাতা, দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার, কি মিষ্টি একটি সৌরভ ছড়িয়ে থাকত বাড়িময়। হ্যাঁ, একটু যে পুরোনো সময়টার জন্য কষ্ট হতো না, তা বলা যাবে না। হতোই, খুব হতো। পুরোনো ক্লাসের সব বন্ধুকে তো আর নতুন ক্লাসে পাওয়া যেত না। মহল্লার অনেক বন্ধু বাসাবদল করে চলে যেত। পরিবার-পরিজনের কেউ কেউ হয়তো দূরে কোথাও চলে গেলেন কিংবা পৃথিবীতেই আর রইলেন না। সেই কষ্টগুলো তো পুরোনো বছরটাতে রয়েই যেত। সেই কষ্টের মধ্যে প্রজাপতি হয়ে আসত নতুন বছর।
প্রজাপতি বড় বেলায় যে ওড়েনি, তা বলা যাবে না। এখনো উড়ছে। তবে জীবনে বেড়েছে সংকট। ব্যক্তিজীবনের অলিগলি পেরিয়ে সমাজের সদর রাস্তা, অতঃপর রাষ্ট্রের মহাসড়ক। টানাপড়েন আছে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্কটা কদাচিৎ সমাধানের দেখা পায়। যাপিত জীবনের ভাবনায় যে ঘাম ঝরে, সেখানে কখনো কখনো সূর্যমুখী ফোটে। শুধু কি ব্যক্তিজীবনের সংকট, উদ্বেগ আমাদের আর্দ্র করে? জাতীয় জীবনের যেকোনো দুর্যোগও বিচলিত করে আমাদের। পাহাড়ধস, বন্যায় বিপন্ন মানুষ নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হই, চাই তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। আবার যখন নিজেরাই জলাবদ্ধতায় বন্দি হয়ে পড়ি, তখন একপ্রকার অসহায়ত্ব আমাদের ভাবলেশহীন করে তোলে। মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আমাদের মানবিক প্রশ্রয় যেমন আছে, তেমনি কিন্তু আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি কবে তাদের প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে, তা জানার জন্য।
কারণ আমরা জানি, এত বিশাল জনগোষ্ঠীর চাপ আমরা সইতে পারব না। আমাদের এখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘিরে। পেঁয়াজ বা চালের দাম নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত জীবনের বাজার খরচকে বিব্রত করেছে। বিদ্যুতের দাম এবং জীবনযাত্রার অন্যান্য যে ব্যয় বেড়েছে, তাতে আমাদের সাধ্যের উঠোন সংকুচিত হয়ে এসেছে আরো। তাই বলে আমরা তো চৌকাঠে গালে হাত দিয়ে বসে নেই। থেমে নেই আমাদের উদ্যমতা। আমাদের মেয়েরা ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছে। শিক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে ছেলেমেয়েরা দেশ-বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছে সাফল্য। জাতীয় পর্যায়েও এসেছে নানা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। তবে যতটা উচ্ছ্বাস নিয়ে এই বিজয় উদযাপনে আমরা মেতে উঠতে পারতাম, ততটা পারিনি। বাসে তরুণী গণধর্ষণ এবং হত্যা, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ, সম্পত্তির জন্য কিশোরী হত্যা এবং নানা পেশার মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের উৎসবের জোয়ারে ভাটা এনে দিয়েছিল।
সেই মন খারাপের জানালা থেকে যখন ঘরের দিকে চোখ ফেরাই দেখি, দেয়ালে নতুন ক্যালেন্ডার উঠেছে। মনোমুগ্ধকর বাংলাদেশের প্রকৃতি পাতায় পাতায়। বছরের পাতার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে প্রজাপতি। বাইরে পাখির কিচিরমিচির, আবারও জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ শুরু নতুন পাতার। নতুন বছরের। আনকোরা বছরটিতে উত্তাপ ছড়াতে পারে রাজনীতি। সুঘ্রাণ শুনতে পাচ্ছি উৎসবের। পূর্বাভাস আছে ভোট উৎসবের। সেই উৎসব হোক সর্বজনীন। উৎসব হোক ভালোবাসাবাসির। উৎসব হোক সকলে সইয়ে নেওয়ার। উৎসব হোক অসুন্দরকে নির্মূলের। আমরা সবাই কোরাস কণ্ঠে বলতে পারি, আমরা মানুষকে ভালোবাসি। ভালোবাসি বাংলাদেশকে। শুভ ২০১৮।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি।