অভিমত
মুদ্রিত বই-ই চির পরাশক্তি
কেন লিখছি, কার জন্য লিখছি? এই প্রশ্নের উত্তর লেখকরা সচরাচর খুঁজেন না বলেই মনে হয়। অথবা উত্তর একটা ঠিক রেখেই প্রশ্নটি নিজেকে করেন। কেন লিখছির এক রকম উত্তর হতে পারে-নিজের আনন্দের জন্য লিখছি। নিজের জন্য নয়, সমাজের কথা ভেবে লিখছি,এমন উত্তরও হতে পারে। কেননা লেখক মনে করতে পারেন-তিনি যা ভাবছেন সমাজের স্বার্থে,রাষ্ট্রের স্বার্থে এটি জানানোর প্রয়োজন এবং জানানোর সেই মাধ্যম-লিখে প্রকাশ করা। কখনো সময়কে ইতিহাসের পাতায় ধরে রাখতেও নিতে হয় লেখার আশ্রয়। এই লেখাগুলোই মলাটবন্দি হয়ে বইয়ে রূপ নেয়।
আবার অনেকে কোনো দায় থেকে লিখেন না। তাঁরা মৌসুমে লিখেন। লিখতে গিয়ে গোটা একটা বই লিখে ফেলছেন। তাঁদের লেখার মৌসুম ফেব্রুয়ারি। উপলক্ষ বইমেলা। অন্য দশজন বই বের করছে। তাদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে। গণমাধ্যমে একটু আধটু, আজকাল অনেকটা বেশিই মিলছে কভারেজ। সঙ্গে আছে ফেইসবুক সেলফি, কভার বিজ্ঞাপন সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের সেলিব্রেটি হওয়াটা বেশ স্বস্তাই। কবিতা, উপন্যাস লেখা হয়ে যাচ্ছে ঝটপট। আছে বিদেশ ভ্রমণের ফিরিস্তি। প্রবাসীরাও দূরদেশ থেকে তাদের হৃদয়ের আকুলতা নিয়ে লিখছে। প্রকাশকরাও হা হয়ে বসে আছে-কবে আসবে রকমারী পেশার মানুষ, তাদের গৃহিণী বা স্বামীরা। তাদের সাধ একটা দুইটা বই হোক। প্রকাশকরা তাদের জালে আটকেও ফেলছে ঝটপট। বিনিময়ে টাকা, ডলার, পাউন্ড মিলছে। যেকোনো মুদ্রার বিনিময়েই হোক সমাজে ইজ্জত রাখা বড় কথা।
এই প্রকারের লেখকরা বছরজুড়ে আর কলম, কিবোর্ড, কাগজের সংস্পর্শে থাকে না। তারা সক্রিয় লেখক নয়। সমাজের প্রতি পাঠকের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। মোড়ক উন্মোচন এবং বই ও স্বজন-বন্ধুদের নিয়ে একটা মাস গাল গপ্পে কাটিয়ে দিয়েই তারা খুশি। তাদের খুশির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এই প্রকারের লেখকের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। বইমেলার স্টলগুলোতে বিত্ত-বৈভবের যে ছোঁয়া দেখতে পাই তার পেছনে এদের অবদান আছে। স্বীকার করে নেই অনেক প্রকাশকের পুঁজির জোগান একুশের বইমেলা। কিন্তু পুঁজি উত্তোলন করতে গিয়ে সৃজনশীল এই শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তারা। এখন দেখা যাচ্ছে পুরো বছর সক্রিয় থাকা গবেষক, লেখক-কবিদের চেয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌসুমী লেখকদের বইয়ের স্তূপ বাড়ছে। প্রতি বছর একুশের বইমেলা উপলক্ষে যে পাঁচ সহস্রাধিক বই প্রকাশিত হয়, দেখা যায় তার ২ আনা হয়তো সৃজনশীল চিন্তার এবং সক্রিয় লেখক ও গবেষকদের।
বছরজুড়ে যে লেখকরা সক্রিয় থাকে, তারা অনেকটাই পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ থাকে ঠিকই, কিন্তু লেখার সময় পাঠককে কোন সময়ের কথা বলা হচ্ছে, এবং কোন সময়ের পাঠককে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে তার একটি ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন। একজন লেখক যখন শূন্য শতকে জন্ম নেওয়া পাঠককে উদ্দেশ করে লিখবে কিংবা শিশু-কিশোরদের জন্য লিখবে, তখন তাকে পাঠকের অভিজ্ঞতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যে সময়ের সঙ্গে পাঠকে যোগাযোগ বা অভিজ্ঞতা হয়নি, সেই সময়কে তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পাঠকের সময় এবং অভিজ্ঞতাকে স্বীকার করে নিয়েই লেখক যে সময়ের কথা বলতে চায়, যে অভিজ্ঞতার কথা বলতে চায় তার মিশ্রণ ঘটাতে হবে। না হলে পাঠক ওই লেখা প্রত্যাখ্যান করবে। শিশু-কিশোরদের মনের বয়সে নেমে না গিয়ে তাদের নিয়ে লেখা হবে সময় বা মুদ্রণের অপচয়।
সৃজনশীল প্রকাশনার গৌরবের কাণ্ডারী যারা ছিলেন, সেই প্রজন্মে এখন অবসরেই বলা যায়। কেউ কেউ ঐতিহ্য ধরে রেখে আছেন এখনো। তবে সবার প্রকাশনায় গুণগত মান ও নতুন চিন্তা নেই। এদিকে প্রকাশনায় অফুরন্ত তারুণ্যের সমাবেশ ঘটেছে। তাদের প্রবেশে মান বেড়েছে প্রকাশনার। বইয়ের বিষয়েও এসেছে বৈচিত্র্য। এই নতুনদের বড় অংশটি টিকে থাকার লড়াইয়ে আছে। ছোট অংশটি এসেছে অন্যত্র সংগ্রহ করা পুঁজি নিয়ে সৃজণশীলতার মুখোশ নিতে। তারা প্রকাশনার পরাশক্তি পরিচয়ের রণ দৌঁড়ে আছেন। এই দৌঁড় প্রকাশনা শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে যেমন, তেমনি অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। কারণ এই বাড়তি পুঁজি প্রকাশনায় কতদিন থাকবে বলা মুশকিল। মুখোশ এঁটে গেলে সরে পরার শঙ্কা আছে। এদিকে তাদের পুঁজি ও প্রভাবে লেখক, পাঠকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন নিত্য। কারণ তারা গুণগত ও ঋদ্ধতার বদলে চকিত জনপ্রিয়তারই পৃষ্ঠপোষক হয়ে আছেন।
অন্যদিকে পুরাতন ও নতুনের যে দলটি নতুন সৃজনশীল, মেধাবী লেখক তৈরি, মান সম্মত প্রকাশনায় বিনিয়োগ করছে, সেই বিনিয়োগ নিরাপদ থাকছে না। বলা যায় এক প্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে প্রকাশনা শিল্প। সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে পাঠক হারানো, নতুন পাঠক তৈরি করার উদ্যোগের ঘাটতিও যোগ হচ্ছে। তারপরও সর্বজনীন ভাবে যদি বলা যায়-তাহলে একটি সুবাতাস বইমেলা বা প্রকাশনার ময়দানে বইছে। তা হলো- ব্যক্তি বা জনপ্রিয় ঘরানা থেকে পাঠকরা সরে আসতে শুরু করেছেন। পাঠকরা গবেষণাধর্মী, কর্ম সহায়ক, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিদেশি অনুবাদ, বিস্তৃত পটভূমির কথাসাহিত্যসহ নানা প্রকারের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। পাঠকের রুচি বদলে যাওয়ার সঙ্গে নতুন পাঠক একেবারে তৈরি হচ্ছেনা তা বলা যাবে না।
আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আবহে বইয়ের সমঝদার বরাবরই 'কতিপয়' পরিবারের মধ্যে সীমিত ছিল। সেই কতিপয়ের বিস্তার ঘটছে না, দীর্ঘশ্বাস এখানেই। তারপরও পাঠাগার আন্দোলন, স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বইমেলা নিয়ে যাওয়ার আন্দোলন চলছেই। চলবেও। শঙ্কার কোনো কারণ নেই- অন্তর্জাল যতই পরাক্রমশালী হোক, মুদ্রিত বইকে জয় করা তার সাধ্যে নেই। জয়তু বই।
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি