গল্প
অনুভবের ফসিল
সেই সময় কোনো দেয়াল বা প্রাচীর ছিল না। ট্রেনে বসেই দেখা যেত। স্কুল পেরিয়ে ট্রেন ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ত স্টেশনে। ট্রেন থেকে নামার পরও স্কুলকে আড়াল করা যেত না। পাকুড় গাছটা সবার আগে চোখে পড়ত। তার পেছনে টিনের স্কুলঘর। গ্রামে ঢোকার মুখে ট্রেনে প্রথম স্কুলের পুকুর ধরা দিত। দুপুরে পুকুর থাকত গ্রামের দস্যিদের দখলে। ছেলেমেয়ে সবাই জামগাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। বেহালা ছিল ওই দস্যিদের দলে। সরোদ কখনো সেই দলে ঠাঁই পায়নি। গ্রামে থেকেও সাঁতার শেখা হলো না। পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ত দুঃস্বপ্ন। স্কুল পেরোনোর আগেও বেহালাকে পুকুরে ঝাঁপ দিতে দেখেছে। হুম, সেদিন ছিল ওদের স্কুল থেকে বিদায়ের দিন। সরোদের সামনে যখন এসে দাঁড়িয়েছিল, বেহালার শরীর থেকে তখনো পানি ঝরছিল। ঝরেপড়া পানির প্রতিটি ফোঁটা যেন মুক্তদানা। সরোদের তাই মনে হয়েছিল। মাঘের শেষ দিকে রোদে সেদিন উষ্ণতা ছিল। বেহালা বলেছিল, কিরে, কিছু বলবি? সরোদ কী বলবে ভেবে উঠতে পারছিল না। বেহালা তাকিয়েই ছিল ওর দিকে। সরোদ কোনো রকম বলতে পারল, পরীক্ষার হলে নার্ভাস হবি না একদম। মাথা ঠান্ডা রাখবি। এই কথা শুনে বেহালার সে কি হাসি। ও বলেছিল, সেই জন্যই তো পুকুরে ডুব দিয়ে গেলাম। তুই তো ডুব দিতেও জানলি না।
সরোদ গ্রাম ছেড়ে শহরে গেল। ইচ্ছে ছিল ঢাকা যাবার। হলো না যাওয়া। কেমন করে যেন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল ও। সংগঠনের নির্দেশ ছিল জেলা শহরে থাকার। রাজনীতি করতে চেয়েছিল কি না, সেটা আজও বুঝে উঠতে পারেনি সরোদ। ও শুধু মেনে নিতে পারেনি- জেলে মাছ ধরবে, মহাজান সেই মাছের কাঁটা বাছবে। ওই মাছের স্বাদ নেওয়ার অধিকার জেলেরও থাকবে। এই সামান্য চাওয়াটুকুই নাকি এই পৃথিবীর বড় রাজনীতি। এই অঙ্ক মেলাতে পারেনি, পারছে না কোনো গণিতবিদ। সরোদকে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াতে হতো। জেলেদের মুখে ভাষা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়েছিল সরোদের কাঁধে। তাই জেলা শহরের কলেজেই পড়েছে ও। কলেজ স্লোগানে মুখর হতো। কত ছাত্র সংগঠন। দেয়ালে দেয়ালে বিপ্লবের স্লোগান। নেতানেত্রীকে তুষ্ট করে কত পঙ্ক্তিমালা। সরোদ সেদিকে তাকায়নি। ও হেঁটে গেছে জলাধারের পাড় ঘেঁষে। জমির আইল বরাবর। শ্যামা একদিন বলেছিল,তুমি আমাদের সঙ্গে আস। সরোদ জানতে চেয়েছিল, কেন? একটি মিছিলের দিকে ইশারা করে শ্যামা বলেছিল, আমাদের লাকড়ি দরকার। সরোদ হেসে উত্তর দিয়েছিল, সব চুলোতে তো আমি নিজেকে পোড়াই না।
শ্যামা যেমন বক্তৃতা দিতে পারত, তেমনি স্লোগান ধরাতেও ছিল পটু। সাইকেল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস, শহর ঘুরে বেড়াত। কখনো কখনো সরোদকে দেখে নেমে পড়ত। কথা জমিয়ে তোলার চেষ্টা ছিল ওর। সরোদ শুনতে ভালোবাসত। বল তো কম। শ্যামা যেমন বলত, দেখ সবাই বলছে দেশ বদলে ফেলবে। কে বদলে ফেলবে? ওদের নেতা বদলে ফেলবে? এই কথা বলে শ্যামা শব্দ করে হাসতে থাকে। সরোদ বলে, হাসছ কেন? শ্যামা হাসি সামলে নিয়ে বলে, ওদের নেতা বদলে ফেলবে দেশ, আরে বাবা ওর নেতা নিজেই তো নিজেকে বদলাতে পারেনি। সরোদের কথাটা ভালো লেগেছিল। আরো ভালো লাগে যখন শ্যামা বলে, বলো নেতার ওপর কেন দেশ ছেড়ে দিতে হবে? আমি নিজে কেন দায়িত্ব নিচ্ছি না? কেন বলতে পারছি না আমি, আমরা বদলাব দেশ। শোনো, আসলে হয়েছি কি জানো, আমরা মেঘকে ভালোবাসি, জলের কচুরিকে ভালোবাসি। তাই আমরা নিজেরাও স্রোতে ভেসে বেড়াতে ভালোবাসি। নিজেরা স্রোত তৈরি করার সাহস দেখাতে পারি না। শ্যামার সঙ্গে যখন কথা হয়, সরোদের মনে হয় একটি রাজনৈতিক ইশতেহার পাঠ করল। প্রতিবারই বিদায় নেওয়র সময় একটি শুকনো পাপড়ি সরোদের করতলে গুঁজে দিয়ে যেত শ্যামা। বলত ও, প্রাণের চেয়ে ফসিলের ভাষা অনেক স্পষ্ট শুনে দেখ০।
সরোদকে কয়দিন ঢাকায় থাকতে হয়েছিল। সংগঠনের কাজেই। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ঘুরে শ্রমিকদের কথা বলতে হয়েছে। ন্যায্য মজুরি, উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে কী করে বঞ্চিত রাখা হয়, সেই কথা লাল পতাকার ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের জানানোর দায়িত্ব ছিল সরোদের। এ কাজে এসে সরোদ বিস্মিত হয়েছে। ওরা চায়ের টেবিলে পুরো পৃথিবীকে যেন হাজির করে ফেলছে কথার জাদুতে। কিন্তু একজন কৃষক কেন, কোনো অনিবার্যতায় তার ফলন অগ্রিম বেচে দেয়? এই সত্য তাদের অজানা। চায়ের টেবিল থেকে উঠে পড়ার পরে তাদের জীবনে বুর্জোয়া রং কত গাঢ় হয়, তাও দেখা হয়ে যায় সরোদের। বিষয়গুলো সরোদের পছন্দ হচ্ছে না। ও খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না এ পরিবেশের সঙ্গে নীতা বুঝতে পারছিল।
নীতা শ্যামার মতো কলকল করে কথা বলে না। পুরো দিনে হয়তো ঠিক করে একটি বাক্যও বলতে শোনা যায় না। ও যেন সব কিছুর পর্যবেক্ষক। কারো হয়ে সব দেখে যাচ্ছে। নিজের জন্য নিজে দেখে যাচ্ছে এমন মনে হয় না। নীতাকে সন্দেহ করত সরোদ।ও হয়তো সংগঠনের ভেতরকারই কোনো চর। নীতা একদিন পাশে হেঁটে যেতে যেতে বলছিল, এই দৃশ্যই সত্য। সরোদ জানতে চেয়েছিল, কোন সত্য? নীতা সরোদের দিকে গাঢ় হয়ে তাকায়। ওই চোখ দেখে সরোদ কেঁপে উঠেছিল। নীতার দিকে তাকানোর দুঃসাহস হয়নি। ফিরে আসার দিন নীতাই ওকে এগিয়ে দিয়ে গেছিল বাস টার্মিনালে। সরোদ যখন উঠে যাচ্ছিল বাসে, তখন পেছন থেকে নীতা বলে, থেকে গেলেই পারতে।
সরোদ কোথাও অবসর নিতে পারেনি। নতুন নতুন পরোয়ানা জারি হয় তার ওপর। ফিরে আসতে হয় নিজ শহরে। এসে শ্যামাকে পায়নি। চলে গেছে ও। ইশতেহার ছিঁড়ে গেছে। যেভাবে কলেজ গেইটের উপরে বিদ্যুতের তারে আটকে আছে ক্ষতবিক্ষত গোলাপি রঙের ঘুড়ি। শ্যামা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। বলে গেছে গবেষণার জন্য যাওয়া। হাজার বছর আগে নাকি এ দেশ থেকে মুসলামান ব্যবসায়ীরা উট নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যেত। শ্যামা সেই ইতিহাস খুঁজতে গেছে। সরোদ ভরসা পাচ্ছে না। এমন কথা বলে কত মানুষই গেল। গিয়ে নিজেরাই গবেষণার বিষয় হয়ে গেছে। শ্যামার দেওয়া শুকনো পাপড়িগুলো জমা আছে। সেই ফসিলের ভাষা পড়তে শেখা হয়নি সরোদের। পাপড়িগুলো নানা রঙের। শ্যামা কেন একেক রঙের পাপড়ি দিত? ওর মনের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে, নাকি রাজনীতির রং যে বদলে যায়, তা বুঝাতে?
নিজ শহরে, ঢাকায় তরুণদের দেখেছে সরোদ। ওরা কত উৎফুল্ল। সম্পর্কগুলোও কেমন মচমচে। জীবনকে উদযাপন করতে শিখেছে ওরা। সরোদ পারল না। নিজেই ভাবে জীবনকে যাপন করতে পারা শেখা হলো না এত দিনেও। কিন্তু ও নিজেও তো কোনো এক রকম যাপনের স্বপ্ন দেখে। দেখাতে চায়। সরোদ জানে চাইলেই ডুব দেওয়া যায় না। সাঁতার জানতে হয়। তেমনি যাপন করাটাও শিখে নিতে হয়। নীতা বলেছিল থেকে যাওয়ার জন্য। পারল না তো সরোদ। কীভাবে থেকে যেতে হয়, কাছে থেকে যাবে? এই ঠিকানাগুলো সরোদের কাছে স্পষ্ট নয়। অথচ ঢাকায়, নিজের শহরে ছেলেমেয়েদের দেখছে কত সহজেই থেকে যায় ওরা, এত সহজে ঠিকানা চিনে নিতে পারে ওরা, তা দেখে সরোদ বিস্মিত হয়। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতেই বুঝি ভাবে, বেশি মচমচে বলেই ভেঙেও যায় সহজে। বদলে যায় ঠিকানা। নীতা যে দৃশ্যের কথা সত্য বলেছিল, এগুলো বুঝি সেই সত্য?
স্কুল চারদিকে শুধু যে প্রাচীর উঠেছে তা নয়। টিনের চালা উড়ে গেছে হয় ঝড়ে না হয় বিত্তে। স্কুল ভবন জিরাফের মতো গলা উচিঁয়ে আছে। যেন পুরো গ্রাম দেখে নেবে। রেলস্টেশন পাল্টে যায়নি। মরচে রংটা আরো উজ্জ্বল হয়েছে। টিকে গেছে পাকুড় গাছটাও। পুকুরে এই ফাগুনে জল নেই। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পুকুর ভর্তি হয়ে আছে। আশ্চর্য খেলছে না কেউ। সবাই বসে গল্প করছে জটলা বেঁধে। আজকাল সবাই কথা বলতেই ভালোবাসে। ওদের সময় হলে এই শুকনো পুকুরকে নিয়ে কত খেলা যে বানিয়ে ফেলত ওরা। মন শুকিয়ে এখন কথা খৈ ফোটে। সরোদ শুকনো পুকুরের গভীরতা মেপে নেয়। জল ভরা পুকুরে তো ডুব দেওয়া হয়নি, সরোদের ইচ্ছে হচ্ছিল শুকনো পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার। এক পা বাড়াতেই মনে হলো, বেহালা হাসছে পেছনে দাঁড়িয়ে। একটা ঢিলও বুঝি ছুঁড়ে দিল, কাপুরুষ! সরোদও ছুঁড়ে দেয় পাটকেল, ভালোবাসি!