অভিমত
মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কতটা নিখাদ?
আতঙ্ক গলিতে পৌঁছে গেছে। ল্যাম্পপোস্টের নিচে, মোড়ের দোকানের যে ভিড় ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। মহল্লা বা এলাকাতে যে জটলাগুলো ছিল সন্দেহের , সেই জটলা কমে গেছে। কমেছে অপরিচিতদের পদচারণা। পরিচিতদের যাদের চলাচল অস্বাভাবিক ছিল, তাদের দেখা মিলছে না। কিছু দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। কিছু বাড়ি থেকে আত্মচিৎকার, চাপা কান্নার শব্দ এখন আসছে না। সেই সবকিছুই গত কয়েকদিনে দেশব্যাপী মাদকের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণ। মাদক পরিবার, সমাজকে এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে শয্যাশায়ী করে তুলেছিল। গত প্রায় চার দশকে মাদকের যে ভয়াল বিস্তার, তার নিরাময়ে কম টোটকা তো প্রয়োগ করা হয়নি, কিন্তু নিরাময় মেলেনি।
মাদকের যেমন সরাসরি বেচাকেনা জমজমাট হয়ে উঠেছে, তেমনি মাদকবিরোধী অভিযান, সচেতনতা কার্যক্রম এবং নিরাময়েরও এক প্রকার বাণিজ্য জমে উঠেছিল। মাদককে নানা সংগঠনের ব্যানার থেকে যারা ‘না’ বলেছে, তারা নিজেরাই মাদকের নিবিড় আসক্তিতে ছিল। আসক্তদের চিকিৎসার যে কেন্দ্রগুলো খোলা হয়েছে, সেগুলো অনেকগুলোর বিরুদ্ধেই অভিযোগ ছিল মাদক ব্যবসার। অনেক পরিবার, ব্যক্তি প্রতারিত হয়েছে এসব কেন্দ্র থেকে। ফলে চিকিৎসা নেওয়ার পরও মাদক চক্র থেকে মুক্তি মেলেনি বেশিরভাগেরই। জনপ্রতিনিধিরা মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার আহ্বান, অঙ্গীকার করেছে-কিন্তু নিজেকে তারা মাদক মুক্ত রাখতে পারেনি। আসক্তির দিক থেকে, ব্যবসার দিক থেকেও। এলাকা ভিত্তিক এবং বৃহত্তর বাজারের মাদক ব্যবসার সঙ্গেও জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার কথা আলোচিত। যদিও স্বরষ্ট্রমন্ত্রী একজন জনপ্রতিনিধির প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, প্রমাণ নেই। সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়-অভিযোগ তো বিরুদ্ধ পক্ষই শুধু করছে না। দলের লোকেরা করছে। স্থানীয় মানুষ করছে। এমন অভিযুক্ত লোকের সঙ্গ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগের মতো জনপ্রিয় ও শক্তিশালী দল কি খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
মাদক চোরাচালান, ব্যবসা ও সেবন প্রতিরোধ ও নির্মূলে সরকারের ভরসা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবাক বিস্ময় হলো সরকারের পর সরকার চলে গেছে, কোনো কোনো দল সরকারে আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদকের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি। কারণ মাদক গ্রাস করেছে তাদেরও। মাদকের নেশায় নেতিয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যও। অভিযোগ আছে মাদক ব্যবসার লেনদেন পরিচালিত হতো কোন কোন থানা থেকে। এই বাস্তবতায় সরকারের সিদ্ধান্ত, উদ্যোগ থাকার পরও সফল হওয়া যায়নি মাদক নির্মূল অভিযানে।
সমাজ ও রাষ্ট্রে এক প্রকার ধারণা তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক প্রশ্রয় আছে মাদক ব্যবসায়ীদের ওপর। তরুণ সমাজ মাদকে আসক্ত থাকলে তাদের পক্ষে যেকোনো অনিয়মে, অনৈতিকতায় সোচ্চার হওয়া সম্ভব হয় না। ফলে এক প্রকার রাজনৈতিক ও সামন্ততান্ত্রিক ষড়যন্ত্রও ছিল। কিন্তু একপর্যায়ে দেখা গেল মাদক কোনো একটি বিশেষ শ্রেণিকে ছোবল দিয়ে বসে থাকেনি। সমাজের সব ঘরেই মাদকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে নির্জীব, নিষ্প্রাণ ও স্বপ্নহারা এক জাতিতে রূপ নিতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ভাঙনের সেই আওয়াজ দেরিতে হলেও রাষ্ট্রের শীর্ষ কুঠুরীতে পৌঁছেছে। রাজনীতি বুঝতে পেরেছে নির্জীব তারুণ্য, স্বপ্নহীন প্রজন্ম দিয়ে কোনো উন্নয়ন উদযাপন সম্ভব নয়। উন্নয়নকে টেকসই রাখার কারিগররা যদি নিষ্প্রাণ থাকে, তবে সেই উন্নয়ন হবে নিষ্ফল। এই বাস্তবতা থেকেই সরকার মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ অভিনন্দন পাবার যোগ্য ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ যদি হয় কেবল বন্দুকযুদ্ধ তাহলে অভিযান, লড়াই প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যাবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি বন্দুকযুদ্ধে যে মাদক ব্যবসায়ীরা নিহত হচ্ছে, তারা মামুলি ব্যবসায়ী। তাদের পেছনে যে মহাজন ও প্রশ্রয়দাতারা রয়েছে, তারা থেকে যাচ্ছে অধরা। তাদের আইনের আওতায় আনাতো হচ্ছেই না, তাদের নামটি পর্যন্ত উচ্চারিত হচ্ছে না। মাদক ব্যবসা, চোরাচালানের মূল মহাজনদের নির্মূল না করতে পারলে এই যুদ্ধ অসমাপ্ত রয়ে যাবে। যদি মহাজনদের চিহ্নিত করা যায় বৃহত্তর বাজারে, চিহ্নিত করা যায় গলির খুচরো ব্যবসায়ীদের, মাদকের রুটে প্রাচীর তোলা যায় কোনো আপস না করে, তাহলে মাদকের যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব হবে। সুতরাং মাদকের বিষয়ে সরকারের যে শূন্য প্রশ্রয়ের অবস্থান তা যেন সবার জন্যই প্রযোজ্য থাকে। তবেই মাদকের বিরুদ্ধে ঘোষিত যুদ্ধ ফলাফল এনে দেবে। না হলে এটি ঘোষিত যুদ্ধ রূপেই নিষ্ফল দামামা বাজিয়ে যাবে।
লেখক : বার্তা প্রধান, সময় টিভি