তিন নায়িকার স্মৃতিতে মান্না
বাংলা চলচ্চিত্রের প্রতিবাদী নায়ক হিসেবেই পরিচিত ছিলেন তিনি, তাঁর নাম এস এম আসলাম তালুকদার, এ নামে নয়, তিনি পরিচিত মান্না নামেই। আজ ১৭ ফেব্রুয়ারি মান্নার সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর এই প্রয়াণ দিবসে নায়ক মান্নাকে স্মরণ করছেন আত্মীয়পরিজন ও সহকর্মীরা। মান্নার বিপরীতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন এমন তিন নায়িকা মৌসুমী, অপু বিশ্বাস ও স্বাগতার স্মৃতিচারণা নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ডালি।
মৌসুমী
অভিনেত্রী
মান্না ভাই আমার অনেক কাছের বন্ধু ছিলেন। ‘লুটতরাজ’ ছবিতে আমি তাঁর সাথে প্রথম কাজ করি, তারপর প্রায় ৪০টি ছবিতে আমরা এক সঙ্গে কাজ করেছি। মান্না ও আমার মধ্যে কাজের বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ, তেমনি ছিল বন্ধুত্বটাও।
একটা সময় ওমর সানি কাজ কমিয়ে দিচ্ছিল, আবার অশ্লীলতার প্রকোপে সিনেমায় কাজও করা যাচ্ছিল না। মান্না না থাকলে আমার তখন সিনেমা থেকে সরে যেতে হতো। কিন্তু আমার বন্ধু মান্না ভাই সেটি হতে দেননি, একের পর এক ভালো ছবি করেছেন। তাঁর ভাবনাচিন্তার সবটাই ছিল চলচ্চিত্রকে ঘিরে। ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা, আবার রাতে ঘুমানো পর্যন্ত সব সময়ের চিন্তাই ছিল ছবি নিয়ে। গানের জন্য সুন্দর লোকেশন, ফাইটের নতুন ধরন বা সম্পাদনায় নতুন সাউন্ড এফেক্ট, নতুন কিছু তৈরি করা- আজীবন এগুলো নিয়ে তিনি ভেবেছেন, কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে।
আজ সাত বছর হলো তিনি নেই। ২০০৮ সালের এই দিনটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। মান্না ভাই এর আগে রাত অবধি শুটিং করলেন, এফডিসি থেকে হাসিমুখে বিদায় নিলেন, সকালবেলা জানতে পারলাম তিনি হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমরা তো হতবাক সবাই। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে লাগল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন মান্না ভাই, ইউনাইটেড হাসপাতালে। দুপুরে সবাইকে শোকে স্তব্ধ করে চলে গেলেন মান্না ভাই। এমন দুঃসংবাদের জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।
আজও চলচ্চিত্রের শুটিং-ডাবিং থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র আন্দোলন, যেকোনো ভালো বিষয়েই উঠে আসে মান্নার নাম। আজও আমরা সবাই মান্না ভাইয়ের অভাবটা প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। মান্নাবিহীন ঢাকাই সিনেমা যেন অনেকটাই মলিন। মান্নাবিহীন পুরো চলচ্চিত্রটাই কেমন যেন ছন্নছাড়া। তাই তো শুটিং থেকে শুরু করে ব্যবসা, এমনকি আন্দোলনের সময়ও মান্না ভাইয়ের কথা সবার মনে পড়ে। সবাই অকপটে স্বীকার করেন, মান্না থাকলে এমনটি হতো, কিংবা মান্না থাকলে এমনটি হতো না। কারণ, মান্না ভাই শুধু একজন নায়ক কিংবা অভিনয় শিল্পীই ছিলেন না। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক নিবেদিত প্রাণ একজন সিনেমাপ্রেমী, সিনেমাকর্মী।
অপু বিশ্বাস
অভিনেত্রী
২০০৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, এফডিসির ঝর্না স্পটে “গরিবের ছেলে বড়লোকের মেয়ে” ছবিতে আমাদের বাসার একটা সিকোয়েন্সের শুটিং চলছিল। শটটা ছিল এমন- আমি মান্না ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি, আমার বাবা আমাকে টেনে নিয়ে যাবে। কারণ আমি যাকে ভালবাসি (মান্না ভাই) সে সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক, এটা আমার বাবা কিছুতেই মেনে নেবে না।
শুটিং শেষে মান্না ভাই আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিয়ে বললেন- ‘দেখ এই দুনিয়াতে মানুষ তো আর চিরদিন থাকে না। আমি তোকে দোয়া করে গেলাম, তুই অনেক বড় অভিনেত্রী হবি। আর বড় অভিনেত্রী তো অনেকেই হয়, কিন্তু তুই মনে রাখার মতো বড় অভিনেত্রী হবি। আমার কেন জানি মনে হলো তোকে দোয়া করে যাই।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু টাকা কেন’? মান্না ভাই বললেন, “বাবা তুই তো আমার ছেলের মতো, তুই এই টাকা দিয়ে শপিং করবি। আমার ভালো লাগবে। মান্না ভাই আমাকে আদর করে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন।”
আমাকে আরো বললেন, “বাবা তুই কালকে একটু সকাল সকাল আসিস। তোর সাথে আমার একটা সিকোয়েন্স আছে। এটা করেই আমি একটু বাইরে যাব। ১০টায় তুই মেকআপ, গেটআপ নিয়ে ক্যামেরার সামনে থাকবি।”
পরের দিন আমি সকালে এসে এক নম্বর মেকআপ রুমে রেডি হয়ে বসে আছি, কিন্তু মান্না ভাইয়ের কোনো খবর নেই। ১০টা বাজে ১১টা বাজে, কোনো খবর নেই। ১২টার সময় একজন সহকারী আমাকে ফোনে বলল, মান্না ভাই অসুস্থ। আমি মনে করলাম দেরি হচ্ছে বলে মিথ্যা বলছে, আমি ভাবলাম মান্না ভাই তো! একটু দেরী হলে সমস্যা নেই। ১টা বাজে, ২টা বাজে কারো কোনো খবর নেই দেখে আমি পরিচালক সমিতিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি টিভিতে ব্রেকিং নিউজ যাচ্ছে মান্না ভাই নেই।
আমার সাথে সাথেই কানে বাজতে লাগলো আগের রাতের কথাগুলো। দোয়া করার সময় বলেছিলেন, ‘আমার তো তোর সাথে খুব বেশি কাজ করা হয়নি। আমার কেন জানি মনে হয়েছে আমি তোকে দোয়া করে যাই, মানুষ তো সারা জীবন বাঁচে না। তুই অনেক বড় অভিনেত্রী হবি।’
স্বাগতা
অভিনেত্রী
আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যারের অনুপ্রেরণাতেই আমার অভিনয় করা , যখন ‘দরিয়া পারের দৌলতি’ ছবির শুটিং করছিলেন, পুরো ইউনিট আমাকে খুব পছন্দ করত, তারা বলছিল আমি ইউনিটে থাকলে খুব ভালো হতো, আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যারের পরের ছবির নায়িকা আমি, অমি ভালো অভিনয় করব। আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যারের ‘দরিয়া পারের দৌলতি’ ছবির শুটিং করছিলেন মান্না ভাই, সেখানেই তিনি আমার কথা শুনেছিলেন। ইউনিট থেকে নম্বর নিয়ে মান্না ভাই আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলেন। আমি প্রথম তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম বাসার একটা সাধারণ ড্রেস পরে। কিন্তু তিনি আমাকে এই সাধারণ গেটআপেই পছন্দ করলেন।
আমার প্রথম শুটিং শুরু হয় গানের অংশ দিয়ে। টাঙ্গাইলের জমিদার বাড়ি, রাতের ভুতুড়ে পরিবেশ, লাইট দিয়ে আরো ভৌতিক একটা পরিবেশ করে গানের শুটিং। আমি নাচ জানি না, এরপরও নাচ করলাম। সবাই হাততালি দেওয়ার পর বুঝলাম, ভালো করেছি। মান্না ভাইয়ের সাহসে কাজ করছিলাম, আর প্রথম দিনই পুরো ইউনিট তাকে আপন করে নিয়েছে।
একদিন প্রজেকশনে আমাকে দেখালেন, আমি কত ভালো নাচ করি। এই যে উৎসাহ দেওয়া, এটাই একটা মানুষকে এগিয়ে দেয় অনেক দূর। পরে আরো সাহস নিয়ে কাজ করতে পেরেছি। উনি আমাকে দিয়ে আমার কাজটাই করিয়েছেন, পেছনে থেকে সাহস দিয়েছেন।
মান্না ভাই যা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতেন তা হচ্ছে চলচ্চিত্র, নাস্তার টেবিলে বসে আপেল খেতে বসে বলতেন- দেখ তো, এই আপেলটা শটে খুব ভালো লাগত। আমার বন্ধুরা একদিন শুটিংয়ে দেখা করতে এলো। এর দুদিন পর গানের শুটিংয়ে আমাকে বললেন, তোমার ওই বন্ধুর মতো আমার চুলগুলো করে দাও তো। এই যে নতুন কিছু করা, এটা ওনার মাঝে খুব বেশি ছিল।
প্রতিটি অভিনয় শিল্পীর একটা স্বপ্ন থাকে যে ভালো একটা চলচ্চিত্রে কাজ করার। বোঝার আগেই মান্না ভাই আমাকে সেটা দিয়ে গেলেন। ‘শত্রু শত্রু খেলা’ আমার একমাত্র ও ব্যবসাসফল ছবি। মান্না ভাই এভাবে জোর করে আমাকে কাজ না করালে সিনেমায় কাজ আমার হয়তো কেবল স্বপ্নই থেকে যেত।
মান্না ভাই ২০০৮ সালের আজকের এই দিনে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। এই মহানায়কের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।