এফডিসি ছাড়ছেন মুক্তিযোদ্ধা রফিক সরকার
বাংলা চলচ্চিত্র মানেই হয় তো অনেকের মনে ভেসে ওঠে নায়ক নায়িকা বা পরিচিত কোনো খলনায়কের চেহারা। পার্শ্ব অভিনয়শিল্পীদের চেহারা কারো হয় তো মনে থাকে, তারো থাকে না। খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা পার্শ্ব অভিনেতা বা অভিনেত্রীর নাম মনে রাখেন। তেমনি একজন অভিনেতার নাম রফিক সরকার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর পরই তিনি যুক্ত হন চলচ্চিত্রের সঙ্গে, অভিনয়ের মাধ্যমে।
অভিনেতা রফিক সরকারের অভিনয় জীবন আর বাংলাদেশের বয়স প্রায় সমান। সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে, বলেছেন অভিনয় জীবনের কথা, বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা, জানিয়েছেন নতুন যুদ্ধে নামার কথা। স্মৃতিচারণা তিনি করছিলেন এফডিসি কেন্টিনের সামনে বসেই।
প্রশ্ন : রফিক ভাই এখানে একা একা বসে আছেন, আজ কোথাও শুটিং নেই?
উত্তর : আর ভাই শুটিং, এই মাসে মাত্র তিন দিন কাজ করতে পেরেছি, সারা মাসই তো এভাবে বসে বসে গেল। এখানে আসাটা নেশা হয়ে গেছে, তারপর একা থাকি বাসায় গিয়ে কী করব? চার দিন ধরে এফডিসিতে কোনো শুটিং নেই। লোকজনও তেমন আসে না, একা একাই বসে থাকি। সিনেমার যে অবস্থা এভাবে চললে তিন মাসের মধ্যে এফডিসিতে তালা লাগবে। বন্ধ হয়ে যাবে ফিল্ম।
প্রশ্ন : ছেলেমেয়ে পরিবারের কেউ কি এখানে থাকে আপনার সঙ্গে?
উত্তর : ছেলেমেয়েরা তো বড় হয়ে গেছে। আমার দুই ছেলে মুন্সীগঞ্জে চাকরি করে, দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বউ আমার সাথে ঢাকায় ছিল, তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি, ছেলেদের সাথে থাকে। আমি নিজেই যেখানে চলতে পারি না সেখানে বউ নিয়ে এখানে থাকা কি সম্ভব?
প্রশ্ন : এখানে কোথায় থাকেন?
উত্তর : গত বছর অক্টোবরে হাতিরঝিলের পাশে একটা ঘর নিয়েছি তিন হাজার টাকা দিয়ে। একলা মানুষ রাতে গিয়ে একটু ঘুমাতে পারলেই হয়। তবে গত চার মাসে অনেক অনিয়ম হয়েছে, এখন শরীর খুব ভালো না। মার্চ মাসটা আছি এপ্রিলে বাড়ি চলে যাব। একাত্তর সালের মার্চে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, এখন স্বাধীনতার প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর আবার নতুন যুদ্ধ শুরু করতে হবে।
প্রশ্ন : কেন নতুন যুদ্ধ শুরু করতে হবে কেন?
উত্তর : মুন্সীগঞ্জে আমার ছোট ভাই থাকে, আমার নামে কিছু জমি আছে সেখানে। আমার ছোট ভাই সেসব দেখে রাখে। এখন ভাবছি জীবনের শেষ সময়টা বাড়িতেই কাটাব। আমি তো আর চাষাবাদ জানি না। তারপরও ভাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করব। ছোটবেলাটা বাড়িতে কাটিয়েছি তো ভালোই লাগবে বাড়িতে থাকতে।
প্রশ্ন : এখন থেকে আর অভিনয় করবেন না?
উত্তর : অভিনয় করব না এমন না । বাড়িতে থাকব কেউ যদি ফোন করে তাহলে চলে আসব । রাস্তা তো মাত্র দুই ঘণ্টার। প্রায় আড়াই হাজার ছবিতে অভিনয় করেছি, এখন আর এটা শখের বিষয় নাই। পেটের দায়ে এখন অভিনয় করি। নাম্বারটা রাখেন কেউ চাইলে দিয়ে দিয়েন।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে যুক্ত হলেন?
উত্তর : বয়স তখন ১২-১৩ বছর, চারিদিকে দেখি আগুন লুটপাট, ধর্ষণ আর দেখতে পারছিলাম না। কুমিল্লা হয়ে ভারত, দুই মাস ট্রেনিং করে আবার দেশে ফিরে আসি। আমরা একসঙ্গে ৭০ জন ট্রেনিং করি। যুদ্ধের প্রথম তিন মাসেই আমাদের ১৮ জন মারা যান। আমার একজনের কথা খুব মনে পড়ে। কারণ ওই সময় আমি অল্পের জন্য বেঁচে যাই। গুলিটা ওর গায়ে লাগে আর আমি দুই ইঞ্চির জন্য বেঁচে যাই।
প্রশ্ন : মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকার থেকে কোনো টাকা পান?
উত্তর : আমরা যারা ভারত গিয়ে ট্রেনিং করে যুদ্ধ করেছি আমাদের কারো নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ যায়নি। সবার নামই আছে। আমি প্রতি মাসে এখন পাঁচ হাজার টাকা পাই। সরকার বলেছে সামনে ১০ হাজার টাকা করে দিবে। পাঁচ হাজার টাকাতে এই সময়ে কিছুতেই একজন মানুষ চলতে পারে না।
প্রশ্ন : এফডিসি বা সরকারের প্রতি কিছু চাওয়ার আছে?
উত্তর : দেখেন আমি অভিনেতা, আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমার চাওয়ার কিছু নাই। এফডিসিতে কাজ করে আমি যে সম্মান পেয়েছি তা অন্য কোনো পেশায় হয় তো পেতাম না। চলচ্চিত্রের অবস্থা এখন ভালো না কারণ যারা কাজ করছে তারা কেউ মন থেকে কাজ করছে না। আগে যারা ছবি বানাত তারা মন থেকে ছবি বানাত আর সে কারণে ছবিও মানুষের মনে থাকত। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অভিনয় করতে চাই। যারা আমাকে নিয়ে কাজ করতে চায় আমাকে একটা ফোন দিলেই চলে আসব। আমার নম্বর ০১৭৫৫৭৯৯৭৭৮।