মহাসমুদ্র যাত্রায় কৈশোর তারুণ্যে বই
সংশয়ে ছিলাম আমাদের সন্তানরা গঙ্গা ফড়িং দেখে কি না। শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয়, এই কথা আমার ছেলেমেয়ে জানে ? মেঘের সঙ্গে মেঘের কথোপকথনে ওরা কান পাতে? আমরা ভেবেছিলাম সেই দিকে ওদের চোখ নেই, কান নেই। ওরা চোখ পেতেছে, কান পেতেছে টেলিভিশন, ইন্টারনেট-ইউটিউবে। বইয়ের বদলে ওরা ফেইসবুক পাঠে আসক্ত। খোলা আকাশ, তেপান্তরের মাঠ , উদ্দাম নদী তাদের অভ্যেসে নেই। এই সংশয় থেকেই কৈশোর তারুণ্যে বই’এর যাত্রা শুরু ২০১৬ তে। বই থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া আমাদের সন্তানদের শ্রেনিকক্ষের পাশে আমরা হাজির হই বই নিয়ে।
প্রথম অভিযানেই বুঝতে পারি আমাদের সংশয় ভুল ছিল। আমাদের করোটিতে ধারণার যে কাঠামো তৈরি করে রাখা ছিল, সেই কাঠামোতে ফাটল ধরে। রাজউক কলেজের প্রথম মেলাতেই বুঝতে পারি আমাদের ছেলেমেয়েরা বইকে সরিয়ে দেয়নি তাদের বিছানার পাশ থেকে। পাঠ্যবই সরাতে পারেনি সৃজনশীল বা অপাঠ্য বই। তবে অপাঠ্য বই সরে গেছে এ কথা সত্য। সরিয়ে দেওয়ার কাজটি করেছি আমরাই। অভিভাবক এবং শিক্ষকরা। পরীক্ষা নামের দৈত্যের করতলে তুলে দিয়েছি সন্তানদের। ওই দৈত্য যেমন শরতের আকাশ দেখতে দেয় না ওদের, নিতে দেয় না হেমন্তের ছাতিমের সৌরভ, তেমনি অপাঠ্য বই থেকে সন্তানদের সরিয়ে রাখছে যোজন দূরে। নিজের প্রিয় শহর, প্রিয় নদী, পছন্দের ফুল এমনকি বাংলাদেশ নিয়েও নিজের মতো করে ওরা ভাবতে পারছেনা।শিক্ষক, অভিভাবকরা বলছি-নদীকে দেখার তোমার যে অভিজ্ঞতা আছে। রোদ্দুর-মেঘ তোমার চোখে যে জলছাপ দিয়ে রেখেছে তা সত্য নয়। সত্য হচ্ছে পাঠ্য বইয়ের সহায়ক নামধারী গাইড বই। সেখানে নদীর যে বর্ণনা আছে, নদীকে তোমার সেভাবেই দেখে নিতে হবে। বাংলাদেশকে তেমন করেই হৃদয়ে ধারণ করে নাও। যদি না পারো তবে পরীক্ষা নামক দৈত্য তোমাকে বর অর্থাৎ নম্বর দেবে না। মাঠের বুনোফুল কতটা তোমাকে কতটা মুগ্ধ করল তা ভাবতে গিয়ে কেন সময় নষ্ট, তার চেয়ে নম্বর গুনে নাও।
কৈশোর তারুণ্যে বই শ্রেণিকক্ষের পাশে বই নিয়ে যাচ্ছে, যেন শিক্ষার্থীরা একান্তে বইয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। স্পর্শ করার মধ্যে দিয়ে হোক না বইয়ের সঙ্গে তার আলাপন। পছন্দ করে কোনো একটি বই সে কিনে নিতেও পারে। ঝামেলা এখানেও। আমরা তার মনজগতেও একটি কাঠামো গড়ে দিয়েছি। কতিপয় লেখক ও বিষয়ের বাইরে যেতে পারছে না ওরা। কল্পবিজ্ঞানের বই পাঠ করছে মানেই ভেবে নিচ্ছি আমার সন্তান মেধাবী হয়ে উঠছে। কল্পবিজ্ঞান পড়তে পড়তে ওদের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে মানবিক গুণাবলির ঘাটতি । মানুষ, প্রকৃতির বৈচিত্র্য দেখে এখন ওরা খুব কমই বিস্মিত হয়। কারণ ওদের বিস্ময়ের কোটা শেষ হয়ে গেছে কল্পবিজ্ঞান বইয়ের পাতায়। কোনো কোনো অভিভাবক কল্পবিজ্ঞান পড়তে দিতেও রক্ষণশীল ভূমিকায়। তারা গণিত, বিজ্ঞানের সহজ পাঠ এবং স্কুলেই ক্যারিয়ার বিষয়ক বই তুলে দিতে চায় সন্তানের হাতে। শিক্ষকরা পুরোমাত্রায় সহায়ক বই মনস্ক। তারা অপাঠ্য বই নিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো আলোচনায় যেতে চায় না। স্কুলের পাঠাগারের আলমিরাতে ঝুল ও্ ময়লার স্তর বেশ পুরু হয়ে উঠেছে। অপাঠ্য বই নিয়ে বিদ্যায়তন প্রধান এবং অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাদের অনাগ্রহের সীমা জানা হয়ে গেছে। কোনো ভাবেই অপাঠ্য বইয়ের উঠোনে তাদের আনা যায়নি।
তাহলে কৈশোর তারুণ্যের বই দুই বছর পাড়ি দিয়ে তিন’ এর ঘাটে পৌঁছাতে যাচ্ছে কি করে, মেলা আয়োজনের সংখ্যাও যে ষাট পেরিয়ে গেল? এই উত্তাল যাত্রায় জ্বালানির জোগান দিচ্ছে আমাদের সন্তানরাই। যখন দেখি মাটির ব্যাংক ভেঙে আট টাকার খুচরো পয়সা নিয়ে এসেছে ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী, তখন আমরা যেকোনো প্রতিকূল মহাসমুদ্র পাড়ি দিতে তৈরি হয়ে যাই। কোনো সন্তান যখন অঝোরে কেঁদে বলে তার বাবা অপাঠ্য বই পড়তে দেয় না। লুকিয়ে পড়লে বাবার কাছে নির্মম শাস্তি পেতে হয়। তখন কৈশোর তারুণ্যে বই বিদ্রোহী হয়ে উঠে। কোনো কোনো সন্তান মেলায় প্রতিদিন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসে একটি বই-ই স্পর্শ করে যাচ্ছে বারবার। কিন্তু বইটি কেনার মতো টাকা পায়নি বাড়ি থেকে। ওই সন্তানের হাতে বই তুলে দিতে পেরে কি পরম প্রশান্তির হাওয়া যে বয়ে যায় আমাদের দেহ মনে। পড়ার লোভ আছে, কিন্তু টাকা নেই। কি করা বইটি লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ছেলেমেয়েরা। বিষয়টি যখন আঁচ করতে পারি। তখন বুক গর্বে ভরাট হয়, না, আমাদের সন্তানরা বইকে ছেড়ে যায়নি। ওরা আছে বইয়ের সঙ্গে। বই আছে ওদের সঙ্গে। আমাদের সন্তানরা জেনে গেছে বইয়ের প্রাণ আছে । বইয়ের সঙ্গে কথা বলার চেয়ে আনন্দ আড্ডা নেই আর। শিক্ষকরা সবাই গাইড বইয়ের নিচে চাপা পড়েছে এমন বলব না। পরীক্ষা নামক দৈত্যের কাছে এখনো সবাই নিজেদের সঁপে দেয়নি। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের শিক্ষকরা এখনো অপাঠ্য বইয়ের দলে। তাদের উৎসাহের জোয়ারে বৈঠা বেয়ে চলেছে আমাদের সন্তানরা। কৈশোর তারুণ্যে বই, তাদের সহযাত্রী মাত্র।