ইভিএম পদ্ধতি পুরোটা ডিজিটাল নয়!
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোটগ্রহণ পদ্ধতিকে নির্বাচন কমিশন ডিজিটাল দাবি করলেও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল নয়, বরং এখনো অ্যানালগের ছোঁয়া আছে যেটি আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ।
দুজন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইংয়ের অপারেশন্স প্লানিং ফর এনহেন্সিং অ্যান্ড কমিউনিকেশনসের ইনচার্জ এস এম মাহমুদ আরাফাতের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এস এম মাহমুদ আরাফাত এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইভিএমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়াটি কিন্তু একেবারেই ডিজিটাল। এখানে পুরোনো কোনো পদ্ধতির ছোঁয়া নেই। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ শেষে নির্বাচনী ফলাফল হার্ড কপিতে বা কাগজে লেখা আকারে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হবে। ইভিএমে ইন্টারনেট কানেকটিভিটি না থাকায় সরাসরি ইভিএমের মাধ্যমে ফলাফল পাঠানো সম্ভব নয়। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সার্ভারে পাঠিয়ে দিবেন।’
এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র ও নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ইভিএমে ইন্টারনেট কানেকটিভি না থাকায় পৃথিবীর কোনো হ্যাকার দ্বারা এটা হ্যাক করা সম্ভব নয়, এটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ বি এম আলিম আল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সেই যদি আগের মতোই কেন্দ্র থেকে ফলাফল কাগজে লিখে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাতে হয় তাহলে তো পুরো প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল বলা যাচ্ছে না। ফলাফলের কাগজ তো ছিনতাইও হতে পারে। ফলে এই পদ্ধতিও ঝুঁকিপূর্ণ।’
এই ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সুরাইয়া পারভীন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের ইন্টারনাল সার্ভারে যতক্ষণ পর্যন্ত ভোটের ফলাফল পৌঁছে দেওয়া না যায় ততক্ষণ পর্যন্ত একটা ঝুঁকি কিন্তু থাকেই। কেন্দ্র থেকে প্রিসাইডিং অফিসার কিন্তু ফলাফল পাঠাতে পারছে না সার্ভারে। সুতরাং এই পদ্ধতিকে আমি অন্তত পুরোপুরি ডিজিটাল বলতে পারছি না।’
ড. সুরাইয়া পারভীন আরো বলেন, ‘আসলে ইভিএম এখনো আমাদের জন্য নয়। যে দেশের মানুষ নির্বাচন কমিশনরে প্রতি একটুও আস্থা রাখে না সেখানে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা ঠিক হবে না। বরং কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তা ছাড়া ইভিএমের ডিভাইসটা যারা রান করাবে তারা যদি মনে করে একদিকে ফলাফল নিয়ে যাবে সেটাও কিন্তু সম্ভব। যদি তারা সেভাবে ডিভাইসটা সেট করে। সুতরাং মানুষের ভেতরে আগে বিশ্বাস নিয়ে আসতে হবে এবং আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য মাহমুদ আরাফাতকে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘তাদের মন্তব্যকে ভুল বলার উপায় নেই। যেহেতু এখানে নেট কানেকটিভি নেই এবং ফলাফল ইভিএমের মাধ্যমে সরাসরি পাঠানো যাচ্ছে না সেহেতু তাদের কথারও যৌক্তিকতা আছে। তবে সবেমাত্র ইভিএমের যাত্রা শুরু হচ্ছে। আস্তে ধীরে সব কিছুই ডেভেলপ করা সম্ভব হবে।’
ইভিএমে ভোটগ্রহণ পদ্ধতি
ইভিএমে ভোটগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহমুদ আরাফাত বলেন, ‘সকাল ৮টার আগে ইভিএমে ভোটগ্রহণ শুরু হবে না। সফটওয়্যারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময় সেট করা থাকায় ৮টার আগে ভোটগ্রহণ শুরু করার পারমিশন দেবে না ডিভাইসটি। ভোট শুরু হওয়ার আগে একটি কাগজ বের হবে মেশিন থেকে। কাগজটিতে প্রার্থীর নাম, প্রতীক ও ভোটের সংখ্যা থাকবে। যেহেতু আগে ভোট দেওয়া হয়নি সেহেতু শূন্য ভোটের কাগজ বের হবে মেশিন থেকে। এরপর পোলিং এজেন্টরা ওই কাগজে স্বাক্ষর করলে তারপরে ভোটগ্রহণ শুরু হবে।’
মাহমুদ আরাফাত আরো বলেন, ‘ইভিএম মেশিনে দুটি ইউনিট থাকবে। যার একটি কন্ট্রোল ইউনিট এবং একটি ব্যালট ইউনিট। একটি কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা অনুপাতে কয়েকটি বুথ থাকবে। কার কোন বুথে ভোটগ্রহণ করা হবে সেটি কেন্দ্রে এলেই তাকে জানিয়ে দেবেন কর্মরত আনসার সদস্য। এরপর কন্ট্রোল ইউনিটে গিয়ে ভোটার তাঁর আঙুলের ছাপ দেবেন। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার তাঁকে শনাক্ত করে গোপন কক্ষের ব্যালট ইউনিটে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর তিনি ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসবেন। আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে প্রিসাইডিং অফিসার যদি কোনো ভোটারকে শনাক্ত করতে না পারে তবে পোলিং এজেন্টদের অনুমতি নিয়ে তাঁকে ভোট দেওয়ার সুযোগ দিতে পারবেন তিনি।’
ভোট গণনা ও ফলাফল প্রেরণ
মাহমুদ আরাফাত বলেন, ‘ইভিএমে আলাদা করে ভোট গণনা করা লাগে না। একটি করে ভোট কাস্ট হবে আর ওই প্রতীকে (যে প্রতীকে ভোট পড়বে) একটি করে ভোট জমা হবে অটোমেটিক। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মেশিন থেকে একটি কাগজ বের হবে যেটিতে লেখা থাকবে কোন কোন প্রতীকে কত কত ভোট পড়েছে। যে ফলাফলটি ইভিএম মেশিন থেকে বের হবে সেটি কাগজ আকারে রিটার্নিং অফিসারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এখানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলাফলের ওই পেপারটি রিটার্নিং অফিসার নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সার্ভারে পাঠিয়ে দিবেন।’
আপাতত দ্রুত ফল পৌঁছে লাভ নেই
মাহমুদ আরাফাত আরো বলেন, ‘ইভিএমের মাধ্যমে কিংবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে দ্রুত পাঠিয়ে আপাতত খুব একটা লাভ নেই। কারণ ইভিএম ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোর ফলাফল দ্রুত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেহেতু সম্ভব নয় সেহেতু শুধু ইভিএমের ফল দ্রুত দিয়ে কী হবে? সব এক সাথেই প্রকাশ করা হবে। তবে সব কেন্দ্রে যখন ইভিএম ব্যবহার করা হবে তখন ইভিএমের মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করার নতুন পদ্ধতিও তৈরি করা হবে। এগুলো ডেভেলপমেন্টের বিষয়, আস্তে ধীরে সব হয়ে যাবে।’
এদিকে ইভিএম নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা গত বৃহস্পতিবার বগুড়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ইভিএম বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এ জন্য আরপিও সংশোধন করতে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। যদি সংশোধন হয় তাহলে সীমিত আকারে কিছু কেন্দ্রে সেটি ব্যবহার করা হবে।
কে এম নুরুল হুদা বলেন, ইভিএম এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কোনো অনিয়ম করার সুযোগ নেই। আমাদের আসলে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত। এর মাধ্যমে সকাল ৮টার আগে এবং বিকেল ৪টার পরে কেউ নতুন করে ভোট দিতে পারবে না। এটির মাধ্যমে একজন ভোটার একবারই ভোট দিতে পারবেন। ইভিএম সবার জন্য প্রদর্শন করা হবে। সেখানে সব রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, সুশীল সমাজকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। তারা সুচিন্তিত মতামত দিলে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।