রবার্ট ফিস্কের কলাম
খাসোগির দাফন কি মক্কামুখী হয়েছে?
ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি বিখ্যাত সাংবাদিক রবার্ট ফিস্কের লেখাটি গত ২৫ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। এখানে কিঞ্চিৎ সংক্ষেপিত করে সেটির অনুবাদ প্রকাশিত হলো। অনুবাদ করেছেন ইয়াসির আরাফাত।
মধ্যপ্রাচ্যে জামাল খাসোগি হত্যার তাৎপর্য কতটুকু, সেটা আমি বুঝলাম গত সপ্তাহে। যখন বুঝতে পারলাম এ ঘটনায় আসলে কী ঘটেছে, তা শুধু খাসোগিই আমাকে জানাতে পারতেন। আমার অবশ্যই ফোন করতে হতো তাঁকেই। এ কারণেই তাঁর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তিনিই একমাত্র আরব সাংবাদিক ছিলেন, যিনি আসলেই সত্যিকার অর্থে তাঁর প্রভুর কাছে মাথা নত করেননি। আর এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় দোষ ছিল।
এই ভয়াবহ ও নোংরা হত্যাকাণ্ডের গল্প হিসেবে আমাকে এটা বিশ্বাস করানো সম্ভব নয় যে, ৬০ বছরের একজন লোক ১৫ জনের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তিতে নিহত হয়েছেন। এটি আসলে শুধু সৌদি আরবের সরকারে বর্তমান অবস্থাই তুলে ধরছে না, আমাদের অবস্থাও বলে দিচ্ছে। এরপরও আমরা কীভাবে আরব দেশগুলোকে ভালোবেসে চলেছি? ইসরায়েলও এই ভালোবাসা জারি রাখে। আর আমরা হঠাৎ হতবাক হয়ে যাই, হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। যখন তারা সীমালঙ্ঘন করে, তাদের চরম সহিংস চেহারা নিয়ে হাজির হয়।
এই প্রশ্নের জবাবের বেশ কিছু উপাত্ত আমাদের সামনে রয়েছে। ঘটনার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে এই গল্পই গ্রহণযোগ্য ছিল। পরে যেটি ‘ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ধামাচাপার দৃষ্টান্ত’ বলে প্রতীয়মান হয়। এটি এমন ধরনের হত্যাকাণ্ড, যা তাঁকে সমস্যায় ফেলছে। উনারা জানেন না, কীভাবে নিজেদের পায়ের ছাপ মুছে ফেলতে হয়। সাফ জানিয়েও দিয়েছেন, সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করবেন না তিনি। এদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী একজন, তিনি এই বর্বর হত্যাকাণ্ডকে ‘মার্ডার’ না বলে ‘কিলিং’ বলেই অভিহিত করলেন। এটি আসলে একটি ইঙ্গিত বহন করে, যেখানে আমাদের সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর জানাচ্ছেন, হত্যাকাণ্ডটি ‘ভুলক্রমে’ ঘটানো হয়েছে। তিনি একে ‘মিসটেক’ বলছেন, হ্যাঁ ‘মিসটেক’।
ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের সাবেক রাষ্ট্রদূত এই আল-জুবেইর, যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে হত্যাকারীর অভিযোগ উঠলে তিনি নিজেকে সে ঘটনায় একজন ভুক্তভোগী হিসেবে দাবি করেন। গত বছরও তিনি গণমাধ্যমের সামনে বর্ণনা করেছেন, ইয়েমেনে কীভাবে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলেছে। আল-জুবেইর এবং আমি দীর্ঘদিন ধরে একে অপরের পরিচিত, অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। তাঁর ইংরেজিও খুবই চোস্ত, যখন তিনি ‘মিসটেক’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন তিনি তা ভুলে করেন না, সেটা তিনি বুঝেশুনেই করেন।
ওই বিখ্যাত ধস্তাধস্তিতে জামালের অংশ নেওয়াটা মোটেই উচিত হয়নি। এখানে কোনো না কোনো ঝামেলা হয়েছিল। নয়তো খুনিরা হয়তো তাদের দায়িত্ব বুঝতে পারেনি। খেলাটা আসলে হত্যার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়ার কথা ছিল না। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই জামাল হয়তো তাদের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করে দেন, অথবা খুনিদের কেউই আগ বাড়িয়ে কিছু করে বসেন। তাদের ভুল হয়ে গেছে। অতএব, ১৫ জনের ওই দল সম্পর্কে আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত। আর জামাল খাসোগির মতো কাছাকাছি চেহারার যে লোকটি জামালের পোশাক পরে কনস্যুলেট থেকে বেরিয়ে গেল এবং পরে তার শার্ট-প্যান্ট ডাস্টবিনে ফেলে দিল, তাকেও বেহেশত পাওয়ার আশায় আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত। কালো গাড়ি এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞকেও ভুলে যাওয়া দরকার। তা ছাড়া প্রথম দিন থেকে নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে যে ডাহা মিথ্যা কথাগুলো বলা হয়েছিল, তাও ভুলে যেতে হবে। যেহেতু এটা একটা ভুল।
আমাদের অবাক হওয়াটাও উচিত হয়নি। এ সপ্তাহে রিয়াদে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা সম্মেলনে একজন মন্ত্রীর বক্তব্যে জানা গেল, এটি শুধু ভুল (মিসটেক) নয়, দুঃখ প্রকাশের যোগ্য একটি ঘটনা। যে সম্মেলনে দুনিয়ার অনেক বড় বড় কোম্পানি প্রধান নির্বাহীদের বদলে অধস্তনদের পাঠিয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমানের চকচকে চেহারাটা দেখেছেন? কীভাবে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর সঙ্গে হাস্যরস করছিলেন। এটা আমাদের মেনে নিতে হয়। ধরাছোঁয়ার অযোগ্য, নিষ্পাপ, যেন ধূসর বরফের মতো পবিত্র।
তার ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব যুবরাজ ও রিয়াদের ক্ষমতাশালীদের গ্রেপ্তার এবং লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে অপহরণ করে তাঁর দেশে আলজাজিরা চ্যানেল বন্ধের কথা বলে কাতারে অপমাণ-অপদস্থের ঘটনা কি মোহাম্মদ বিন সালমানকে কোনো রকম মানসিক পীড়া দেয়? এমনটি ভাবার কি কোনো উপায় আছে? আচ্ছা, এমনও হতে পারে কিছু জিনিস তাঁর অজান্তে ঘটে যায়, এমনকি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর যে বলা হলো, তিনি কিছুই জানেন না, এ বক্তব্য সম্পর্কেও হয়তো তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। ধরে নেই এটাও ভুল হয়ে গেছে। ইয়েমেন যুদ্ধও যদি তাঁর জানাশোনার বাইরে ঘটে যেতে পারে, এটাও পরে ভুলে হয়ে যেতে পারে।
আসলে এর চেয়ে ভালো কিছু আপনি আর কী-ই বা আশা করতে পারেন, যেখানে একদল গুণ্ডা সৌদি বিমানে চড়ে ইস্তাম্বুলে নামল। তবে মজার ব্যাপার হলো, তারা ইস্তাম্বুলের আলাদা আলাদা বিমানবন্দর ব্যবহার করেছিলেন, কৌশলটা ভালো ছিল। সেটা কি তুর্কিদের ঘটনার আঁচ পাওয়া থেকে বিরত রাখতে পেরেছিল? নাকি পারেনি? ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ধামাচাপার দৃষ্টান্ত এটি না, এটাও হয়তো ভুলে হয়েছে।
খাসোগি হত্যাকাণ্ডে পশ্চিমা সাহসী এবং নীতিবান নেতাদের বক্তব্যই দেখুন না। কতটা ভণ্ডামিপূর্ণ এবং ক্ষোভ প্রকাশের কী পরিমাণ মুনাফেকি কায়দা তাঁরা দেখালেন। ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে দুই বছর যাবৎ তারা ছিছি করেই যাচ্ছেন, তারা আসলে অস্ত্র বিক্রির জন্য অজুহাত খুঁজছেন। ব্যক্তিগত দায়দায়িত্বের জায়গা থেকে তো দেখেনই না। তারা আসলে খাসোগিকে হত্যার ঘটনাও যেমন গুরুত্ব দেন না, তেমনি ইয়েমেন সংঘাতে নিহত পাঁচ হাজার বেসামরিক মানুষের প্রাণহানিও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড, একটি নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু কিংবা বিয়ের আয়োজনে মেহমানদের প্রাণহানির কোনটি আসলে কতটা হৃদয়বিদারক? এসব তুলনার মানে কী দাঁড়ায়? আমার মনে হয় ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে ‘মানবঢাল’, ‘পূর্ণ তদন্ত’ বা ‘পরিস্থিতিগত ক্ষতি’, আমাদের হাতে এমন প্রচুর অজুহাত রয়েছে। কিন্তু জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডটি ছিল আরো সুপরিকল্পত ও মিথ্যার বেসাতিতে ভরপুর এবং গুণ্ডামির উদাহরণ। এসব অজুহাতের কথা বাদ দিয়ে বরং আমরা যুবরাজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারি। উপরওয়ালার দোহাই! যেই ছুরিটির কথা বারবার বলা হচ্ছে, যেটি দিয়ে খাসোগিকে টুকরো টুকরো করা হয়েছে, যদি জানা যায় ওই ছুরিটি যুক্তরাজ্যের শিল্পনগরী শেফিল্ডে বানানো, তখন আমরা কী বলল?
আমাদের সবার আশা, তাঁকে টুকরো টুকরো করা হয়নি। আদেল আল-জুবেইর যদি না জেনে থাকেন, নিরাপদে রিয়াদে ফিরে আসা ইস্তাম্বুলের সৌদি কনসাল জেনারেলও যদি না জানেন এবং মোহাম্মদ বিন সালমানও যদি না জানেন (তিনি তো এই বর্বরতার কিছুই জানেন না) তাহলে আমরা অন্তত এতটুকু আশা কি করতে পারি? জামালকে মুসলমানদের রীতি মেনে কাফন পরিয়ে ঠিকঠাক মতো জানাজা পড়ে ডানকাত করে পবিত্র মক্কামুখী করে শুইয়ে দাফন করা হয়েছে, সেটা গোপনে হলেও হোক। যে মক্কার আনুষ্ঠানিক রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন মোহাম্মদ বিন সালমানের বাবা বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ।
যদি এমনও হয় যে তুর্কি বর্ণনানুসারে, জামালকে আমাদের প্রিয় ফরেনসিক বিজ্ঞানী টুকরো টুকরো করে হত্যার পর কনসাল জেনারেলের বাসায় বা বনাঞ্চলে নেওয়া হয়েছে, এরপর গোপনে দাফন করা হয়েছে, সেটিও আমাদের বিশ্বাস করা সহজ হবে না। আবারও বলি, যদি বনেই নেওয়া হয়ে থাকে, পথে হলেও যেন তাঁকে জানাজা দেওয়া হয়ে থাকে, আর এতে তাদের দেশেরই পবিত্রতা রক্ষা হয়। যদি তারা ভেবেও থাকে যে তাঁকে হত্যা করে ‘গর্হিতকর ভুল’ তারা করে ফেলেছে। তাদের বিশ্বাস যাই হোক, তাঁকে অবশ্যই মুসলিম রীতি অনুযায়ী দাফন দেওয়া উচিক ছিল। ইসলামী আইন অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করার আগে তাঁকে কাফন পরিয়ে নিতে হয়। জানতে মন চায়, তারা কি সে অনুযায়ী জামালকে কাফন পরিয়ে কবরস্থ করেছে?
তবে জামালের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভেতরের তথ্যগুলো একের পর এক প্রকাশের নেপথ্যে যেই লোকটি ছিলেন, সেই সুলতান এরদোয়ান নিজেও ২৪৫ জন সাংবাদিক এবং ৫০ থেকে ৬০ হাজার রাজনৈতিক লোকজনকে জেলবন্দি করে রেখেছেন। ভয়ংকর ও পৈশাচিক এই হত্যার গল্প সুলতানের কাজেও লাগতে পারে। ভালো কথা, তিনি তো বন্দিদের হত্যাও করেননি এবং কেটে টুকরো টুকরোও করেননি। এমনকি তিনি তো বলছেনও না যে বন্দিরা জেল থেকে পালিয়ে গেছে আর তারা কোথায় আছে, তা তিনি জানেনও না।
জামাল খাসোগি আসলে ক্ষমতা এবং এর ভয়বহতা বুঝতেন। প্রায় বছর পঁচিশেক আগে তিনি খার্তুমে আমার হোটেলে উঠলেন এবং আমাকে সুদানি মরুভূমির মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বিন লাদেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করাতে নিয়ে গেলেন। বিন লাদেনের সঙ্গে তিনি আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধের সময় প্রথম সাক্ষাৎ করেছিলেন। পথে সুদানি পিরামিড পার হওয়ার পর তিনি আমাকে জানালেন বিন লাদেন এর আগে আর কোনো পশ্চিমা সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। ‘খুবই মজার কিছু হতে যাচ্ছে’, আমাকে বলেছিলেন উদ্বেলিত জামাল। দেখার বিষয়, বিন লাদেন একজন কাফেরের সঙ্গে সাক্ষাতে কী আচরণ করেন। আমি প্রথম খাসোগির সঙ্গে সাক্ষাৎ করি ১৯৯০ সালে এবং সর্বশেষ কয়েক মাস আগে আমি বৈরুত থেকে ওয়াশিংটনে টেলিফোনে তাঁর সঙ্গে কথা বলি।
লেখক : পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সাংবাদিক।