সিইসি ভুল বুঝে আশাহত!
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গত ২৫ নভেম্বর সারা দেশে ১২২টি ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি বা নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল নির্বাচন কমিশন। কমিটি গঠন হওয়ার পর থেকে গতকাল পর্যন্ত কমিটির কার্যক্রমে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। আশাহত হয়েছেন বলেও সদস্যদের জানান তিনি।
তবে সিইসি ভুল বুঝে অথবা না বুঝে আশাহত হয়েছেন বলে মন্তব্য কমিটির সদস্যদের! কারণ কমিটির সদস্যদের দাবি, তারা কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা পাননি ইসি থেকে।
গতকাল বুধবার আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনে নির্বাচনী তদন্ত কমিটির সদস্যরা এসেছিলেন তাদের কার্যপরিধি সম্পর্কে জেনে নিতে। তাদের বিফ্রিং করা হয় ইসির পক্ষ থেকে। এতে যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং সহকারী জজের মোট ২৪৪ জন সদস্য অংশ নেন। তাদের উদ্দেশে বিফ্রিং করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররা। বিফ্রিংয়ের সময় সিইসি কমিটির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘২৫ নভেম্বর যখন এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল- আমরা আশা করেছিলাম যে প্রত্যেকটি কমিটি অন্তত ১২২টি অভিযোগ তদন্ত করার কথা ছিল। এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। ১০০টা তদন্ত করার প্রত্যাশা ছিল, ১০০টা বাদ দিলাম, ২২টি তদন্ত করার প্রত্যাশা ছিল। তা হয়নি। কারণ সেটাই, এখন পর্যন্ত আপনারা প্রস্তুতি নিয়ে গুছিয়ে উঠতে পারেননি।’
সিইসি আরো বলেন, ‘আজকে থেকে, এখান থেকে, আপনাদের কী করণীয়, দায়িত্ব এবং কীভাবে এই কমিটি পরিচালিত হবে জেনে শুনে, ফিরে গিয়ে তদন্ত করবেন। মানুষের অভিযোগগুলো শুনবেন, আমলে নেবেন এবং তাদের রিলিফ দেবেন। যাতে তারা যাদের জায়গায় বসে, এলাকায় থেকে, ঢাকা পর্যন্ত না এসে আপনাদের কাছ থেকে, পাশে থেকে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেন।’
নির্বাচনী তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে গতকাল বিকেলে এনটিভি অনলাইনের কথা হয়। এনটিভি অনলাইনকে তারা জানিয়েছেন, কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। সিইসি বোধ হয় জানেনই না যে, আমরা আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে এখনো তেমন কিছুই জানি না। আইন মন্ত্রণালয় থেকে, ইসি থেকে কিংবা রিটার্নিং কর্মকর্তারা আমাদের তেমন কিছুই জানাননি। একই সাথে কমিটির কাজ সম্পর্কে অধিকাংশ প্রার্থী কিংবা ভোটার জানেন না।
এসব ব্যাপারে একাধিক যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং সহকারী জজের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এদের ভেতরে খুলনা অঞ্চলের একটি কমিটির চেয়ারম্যান ও যুগ্ম জেলা জজ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এখানে কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ৯১-এর এ ধারা বলে নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে একটি অফিস আদেশের মাধ্যমে আমাদের জানায় ইসি। শুধু ধারাটার কথা উল্লেখ ছিল, ধারার কাজ কী কী তা আমাদের জানানো হয়নি। সুতরাং ব্যাপারটা আমরাও জানি না ভালো করে। আমরা ভেবেছি নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে আমাদের কাজ শুরু হবে। তার আগে আমাদের বিফ্রিং করা হবে। আজ কিন্তু সেই বিফ্রিংটা হলো। আজ আমরা সব বুঝেছি। আমাদের কী কাজ, কাজের পরিধি কেমন।’
তিনি আরো বলেন, ‘দ্বিতীয় সমস্যা হলো, এই কমিটি প্রথম গঠন করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে সেবারই প্রথম এই কমিটি নির্বাচনের মাঠে কাজ করেছিল। এরপরে ১০ বছর হয়ে গেল। যদিও নামেমাত্র ২০১৪ সালে নির্বাচনের সময় কমিটি ছিল তবে কোনো কার্যক্রম হয়নি। এত দিন পরে এসে প্রার্থীরা কিংবা ভোটাররা ভুলে গেছে যে এই কমিটির কাজ কী। এটার কোনো প্রচার-প্রচারণাও নেই। সুতরাং কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ জমা দেয়নি। এ ছাড়া এখানো আসলে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের মতো তেমন কিছু শুরু হয়নি। যা হয়েছে তা নিতান্তই কম। ১০ তারিখ থেকে পুরো দমে আমাদের কাজ শুরু হবে।’
একজন সহকারী জজ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা এখনো গাড়ির রিকুইজিশন দেইনি। দুজন গানম্যান দেওয়া হবে সেটা দেওয়া হয়নি। কী পদ্ধতিতে আমরা কাজগুলো করব সেসবও বলে দেওয়া হয়নি। কোন পদ্ধতিতে আমাদের কাছে লিখিত আবেদন করবে সেটাও আমাদেরকে বলে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কমিটির অধিকাংশ সদস্য নতুন হওয়াতে এর আগে এই ধরনের কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। কমিটির সদস্যদের ভেতরে খুব কম লোকই এর কার্যপরিধি সম্পর্কে জানে। তবে আজ থেকে সব কাজই করতে পারব কারণ আজই ভালোভাবে আমাদের সব কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
কমিটির অন্য এক সদস্য এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন আমাদের আজ থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে বলছেন। নির্বাচনী অনিয়ম কঠোর হাতে দমন করতে বলেছেন।’ বক্তব্য প্রদানের সময় নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম কমিটির সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা সর্ম্পূণ স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। যেহেতু জুডিশিয়াল অফিসারদের ওপর মানুষের আস্থা আছে সেহেতু সেই আস্থা আপনারা ধরে রাখবেন। আপনারা ভালো কাজ করলে একজন সাবেক জুডিশিয়াল মেম্বার হিসেবে আমি গর্ববোধ করব।’
নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আজ প্রথম এই কমিটির সদস্যদের বিফ্রিং করা হয়েছে। তাদের নির্দিষ্টভাবে কিছু জানানোর নেই। কারণ তারা আচরণবিধি ভঙ্গের অনিয়মের তদন্ত করবে। এটা তো আইন। তাদের জানানোর কী আছে?’
গত ২৫ নভেম্বর গঠিত নির্বাচনী তদন্ত কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (আইন) মো. শরীফ হোসেন হায়দার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সারা দেশে ৩০০ নির্বাচনী এলাকার নির্বাচনপূর্ব সময়ের অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে এসব কমিটি করা হয়েছে। সারা দেশের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কর্মরত একজন যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ এবং একজন সিনিয়র সহকারী জজ অথবা সহকারী জজ, মোট দুজন বিচারক এই কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। জেলার জনসংখ্যা, আয়তন ও ভোটার সংখ্যা বিবেচনায় জেলাভেদে এক বা একাধিক কমিটি করা হয়েছে। যেমন পঞ্চগড় জেলায় একটি কমিটি করা হয়েছে আবার দিনাজুপর জেলার কাজ করবে পৃথক তিনটি কমিটি।’
তিনি আরো জানান, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংসদীয় আসনগুলোর বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত কিংবা সুনির্দিষ্ট অনিয়ম অভিযোগের তদন্ত করবে এসব কমিটি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা যেকোনো প্রার্থী কিংবা রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক কমিটির সদস্যদের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন। আচরণবিধি লঙ্ঘন, যেকোনো ধরনের অনিয়মের বিষয়ে তারা দেওয়ানি আদালতের মতো শুনানি করতে পারবেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের বিষয় আমলে নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শুনানির জন্য হাজির হতে বলবে তদন্ত কমিটি। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা রিটার্নিং, সহকারী-রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারের মতো ব্যক্তিরদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠলে আমলে নিতে পারবে কমিটি। অভিয়োগ ছাড়াও, আইন অনুযায়ী স্বপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ আমলে নিতে পারবেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা।