গপ্পো তক্ক যুক্তি
দর্শক চলচ্চিত্রকে কোকাকোলার মতো করে পেতে চায় : ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা
(হলিউডকে ১৯৭০ সালের দশকে যাঁরা নতুন ধরনের ছবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তাঁর যে কাজ সবাই এক নামে চেনে, সেটা হলো ‘গডফাদার’। ১৯৭২ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটির প্রথম কিস্তি। ডন ভিটো কর্লিয়নির মতো রহস্যময় এবং প্রভাবশালী চরিত্রকে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পর্দায় তুলে এনেছিলেন কপোলা। ‘গডফাদার ট্রিলোজি’ ছাড়াও কপোলার বিখ্যাত সব ছবির মধ্যে রয়েছে ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’ (১৯৭৪), ‘অ্যাপোকেলিপস নাউ’ (১৯৭৯), ‘নিউইয়র্ক স্টোরিস’ (১৯৮৯)। যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে ১৯৩৯ সালে জন্মেছিলেন কপোলা। সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করা হয়েছে দ্য টকস থেকে।)
প্রশ্ন : মিস্টার কপোলা, আপনি একবার বলেছিলেন যে ধনী হলে ভালো শিল্পী হওয়া যায় না। আপনি কি এখনো সেটা বিশ্বাস করেন?
কপোলা : এখন আমি যেটা বিশ্বাস করি তা হলো, টাকা-পয়সা থাকা ভালো, তাহলে আর অন্যের জন্য ফরমায়েশি বাণিজ্যিক ছবি বানাতে হবে না। (হাসি) পয়সা থাকলে আপনার ছবি কে দেখল আর কে দেখল না, তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। যদি আপনি ছবি বানিয়ে পয়সা করতে চান, তাহলে আপনাকে এমন ছবি বানাতে হবে যেটা দর্শক খাবে। দর্শকের পছন্দ বুঝে আপনাকে কাজ করতে হবে। এ কারণেই এত সিক্যুয়াল ছবি হয়। কারণ, তাদের জন্য একটা ছবি বানানো ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যবসায় তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। ব্যবসায় কেউ জেনেশুনে ঝুঁকি নেয় না।
প্রশ্ন : এ প্রবণতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটা কি কঠিন?
কপোলা : এটা অবশ্যই কঠিন। কারণ, দর্শক একটা জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আপনি যখন তাদের ভিন্ন কিছু দেখাতে চাইবেন, তারা সহজে সেটা নিতে চাইবে না। আর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও আলাদা ধরনের সব ছবিকে সমর্থন দেবে না। তারা চলচ্চিত্রকে কোকাকোলার মতো করে পেতে চায়। কারণ, আপনি একটা কোকাকোলা কিনে খেলেন, তার পর থেকে আপনি কোকাকোলা খেতেই থাকলেন আর তারা বানাতেই থাকল। এতেই তো ভালো পয়সা হয়ে যায়।
প্রশ্ন : শিল্পের প্রতি এই অবহেলার কারণ কী?
কপোলা : এগুলো অনেক আগে থেকে চালু রয়েছে। সিনেমার নির্বাক যুগে জার্মানরা কিন্তু ছবির সঙ্গে ছবি মিলিয়ে দারুণ সব গল্প বলেছে। সেখান থেকে আধুনিক সিনেমার যাত্রা শুরু। যখন সিনেমায় শব্দ যুক্ত হলো, এটা সবকিছু বদলে দিল। সিনেমা হয়ে গেল নাটক। মুরনাউ একসময় বলেছিলেন, সিনেমায় শব্দ অনিবার্য। কিন্তু এটা খুব তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। আমরা কেবল সিনেমা বানানো শিখছিলাম। মুরনাউ খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু দারুণ সব কাজ করে গেছেন।
প্রশ্ন : যদি আপনি সিনেমার বাণিজ্যিক সফলতার ধার না ধারেন, তাহলে আপনার মতে সাফল্যের সংজ্ঞা কী হবে?
কপোলা : যখন আপনি কাউকে বাসায় দাওয়াত করেন, মানুষ আসে এবং খাবার মুখে দিয়ে বলে, ‘রান্না ভালো হয়েছে’ বা কোনো কিছু কমবেশি হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই আশা করেন না যে খাবার খেয়ে কেউ মুখের ওপর বলে দেবে, ‘জঘন্য রান্না, এটা মুখেই তোলা যায় না।’ কিন্তু যখন আপনি সিনেমা বানাবেন, দু-এক বছর কাজ করার পর আপনাকে শুনতে হবে, ‘এগুলো কিচ্ছু হয়নি।’ আপনার কাজকে এভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে আপনার আর ছবি বানানোর আগ্রহই থাকবে না। তাই লোকজন আসবে আপনার ছবি দেখার জন্য এবং আপনি যে ছবিটা শেষ করতে পেরেছেন, সেটাই সবচেয়ে আনন্দের। কিন্তু সাফল্য খুবই বিভ্রান্তিকর, সাফল্যের ব্যাখ্যা কে দিচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এর সংজ্ঞা। অর্থকড়ির ব্যাপারটা হচ্ছে বাস্তবতা। তাই সবাই এটা চায়। আমার কপাল ভালো যে আমি অনেক টাকা-পয়সা করতে পেরেছি।
প্রশ্ন : ছবি ব্যবসা না করলে আপনার কি দুশ্চিন্তা হয়?
কপোলা : আমি আমার স্ত্রীকে একবার বলেছিলাম, ‘আমাদের কাছে এত ওয়াইন আছে যে আমরা মরার আগ পর্যন্ত দিন-রাত ওয়াইন খেতে পারব। আর আমাদের মরার পরও আরো ১০০ বছর খাওয়ার মতো ওয়াইন থেকে যাবে।’ পয়সাটাও ওই রকমই। আমি প্রতিবছর একটা করে ছবি করতে পারি, সেগুলো ভালো ব্যবসা করতে পারে, আবার নাও করতে পারে। কিন্তু এভাবে কত দিন যাবে?
প্রশ্ন : বড় অঙ্কের টাকা পেলে কি আপনি এখনো আপনার পছন্দের বিরুদ্ধে গিয়ে ছবি করবেন?
কপোলা : আমি ছবি করি ভালোবেসে। একটা ছবি বানানো অনেক কষ্টের কাজ। আমি কোনো একটা গল্প নিয়ে কাজ করব, এটা ভেবে ছবি বানানো হয় না। যদি আপনি শুধু পয়সার জন্যও সেটা করেন, তাহলেও এর ভেতরে আপনাকে কোনো একটা উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা বেশ্যাগিরির মতো। তাকে কারো না কারো সাথে শুতেই হবে। তাই সে একটা কারণ খুঁজে বের করে, লোকটার চুলগুলো সুন্দর, সে খুবই অমায়িক কিংবা তার গলার স্বর দরাজ। আপনি কী করতে চাইছেন, সেটা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে। যখন আপনি করার মতো কোনো কাজ খুঁজে পাবেন না, তখন যা করবেন সেটা আর আপনার ভালো লাগবে না।
প্রশ্ন : আপনাকে কি আকর্ষণ করে?
কপোলা : আমি কাজ থেকে শিখতে চাই। সেটাতেই আসল মজা। আপনার মাথায় যখন কোনো আইডিয়া আসে বা আপনি যখন কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন, দেখবেন নিজের মধ্যেই একটা ভালো লাগা কাজ করে। আমি যখন ছোট ছিলাম, আমার মনে হতো দুনিয়ায় সব প্রশ্নেরই উত্তর আছে। এমনকি আমার মনে হতো, সৃষ্টিকর্তা কে—সেটা আমি খুঁজে বের করতে পারব এবং তিনি কেন আমাকে সৃষ্টি করেছেন, সেটাও তাঁকে জিজ্ঞেস করতে পারব। ভেবেছিলাম, আমি সবকিছুরই উত্তর বের করতে পারব একদিন, কিন্তু তা পারিনি। (হাসি)
প্রশ্ন : ‘অ্যাপোকেলিপস নাউ’ ছবিটি থেকে আপনি কী শিখেছেন?
কপোলা : ৩২ বছর বয়সে ‘গডফাদার’-এর মতো ছবি বানিয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে কোনো ছবি বানাতে গেলে কোনো প্রযোজক পয়সা দেবেন না, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও এ ধরনের ছবিতে কাজ করতে চাইবেন না—এটাই স্বাভাবিক। শেষমেশ নিজের পয়সায় যখন পরিচালক ছবিটি বানাবেন, তা দেখে ভ্যারাইটির মতো পত্রিকা বলবে, ‘জঘন্য একটা জিনিস হয়েছে।’ এসব মেনে নেওয়া যায় না। সবাই আঁটসাঁট পোশাক পরা সুপারম্যানের ওড়াউড়ি দেখে মজা পাচ্ছে। আমার শিক্ষাটা হলো, আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করেছি, যেখানে ভয়াবহ সব অসংগতি রয়েছে আর মানুষ খুব সহজেই এগুলো মেনে নিচ্ছে। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির দিকেই দেখুন না, একটা ছবিতে আমরা ঘুরেফিরে একই রকমের জিনিস দেখি। যখন কেউ আলাদা কিছু করতে চায় বা দেখাতে চায়, দেখবেন কেউ তেমন পাত্তা দিচ্ছে না।
প্রশ্ন : আপনি এখন আগের চেয়ে অনেকটাই ধীরস্থির। আপনাকে যারা কাছ থেকে দেখেছে তারা বলছে, আপনি আগে এমনটা ছিলেন না। ‘গডফাদার’ থেকে ‘অ্যাপোকেলিপস নাউ’-এর শুটিং করতে করতে আপনি কি নিজেই একজন খেয়ালি ডন কর্লিওনির রূপ ধারণ করেছেন?
কপোলা : আমি অল্প বয়সেই থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে যাই। থিয়েটার ছিল পরিবারের মতো। মহড়ায় যাবেন, মহড়া শেষ করে দলবেঁধে কফি খাবেন, দলেরই কোনো মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করবেন। দলের সবার প্রতি সবার একটা মায়া থাকে। কিন্তু আমি যখন ফিল্ম স্কুলে গেলাম, তখন দেখলাম সবাই কেমন একা। যে যার মতো কাজ করছে। ‘গডফাদার’ করে যখন আমি সফলতা পেলাম, আমি আমার থিয়েটারে শিখে আসা পদ্ধতি প্রয়োগ করলাম। সবাই মিলে একটা পরিবারের মতো কাজ করা শুরু করলাম। জর্জ লুকাস বা মার্টিন স্করসেসির মতো বন্ধু পেলাম, যাঁরা কি না আমার মতোই পাগল। আমার মনে হয়, খামখেয়ালি বা পাগলামিটা সেখানে থেকেই এসেছে।
প্রশ্ন : আপনি একবার বলেছিলেন, ‘সুখ আসলে সুখ।’
কপোলা : আমি সেভাবেই ভাবি।
প্রশ্ন : আরো সুনির্দিষ্টভাবে যদি জিজ্ঞেস করি, ৩০ বছর আগে আপনার কাছে সুখ কী ছিল আর এখন কী?
কপোলা : যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন আমার মামা-চাচা, খালা-ফুফুরা এবং ভাইবোন সব দলবেঁধে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসত। আমরা সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেতাম। তার পর সবাই আয়েশ করে ওয়াইনভর্তি গ্লাস বা আপেলের জুস নিয়ে আড্ডায় বসে যেত। সে সময়ে ওটাই ছিল আমার কাছে সুখ। আমি সব সময়েই পরিবারের সঙ্গে সুখ ভাগাভাগি করে নিয়েছি, পরিবার নিয়েই সুখে থেকেছি। সবাই একসঙ্গে হওয়া, আড্ডা, গল্প। আমার কাছে এখনো সেটাই সুখ। পরিবারের সবাইকে যখন দেখি ভালো আছে, বাচ্চারা আমাদের মতো করেই বাকি ভাইবোনদের সঙ্গে একসাথে বড় হচ্ছে, সেটা দেখেই ভালো লাগে। কারো ওপর কোনো রাগ নেই, ঝগড়া নেই।
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয়, সিনেমা বানানোর ব্যাপারে আপনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন?
কপোলা : না, আগ্রহ হারাইনি। তবে এখন আর আমার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে না। একটা সময় ছিল যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিল, ওদের নিয়ে চিন্তা ছিল। ওদেরকে কীভাবে মানুষ করব, সেটাই ছিল আসল চিন্তা। এমনকি কয়েক বছর আগেও মানুষ বলত, আমি নাকি ব্যবসাসফল ছবি বানাই। আমার ছবিগুলো কিন্তু কখনোই তেমন সফল ছিল না। ‘অ্যাপোকেলিপস নাউ’ দীর্ঘ সময় নিয়ে বানিয়েছিলাম এবং সেটা অনেক ভুগিয়েছে। এমনকি ‘গডফাদার’ নিয়েও ভ্যারাইটি উল্টাপাল্টা রিভিউ লিখেছিল। এসব জিনিস তখন খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। আস্তে আস্তে আমার ছবি মানুষ গ্রহণ করেছে, আমার কাজও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আগামী ১০ বছর পর লোকে বলবে, আমি ভালোই ছবি বানিয়েছিলাম।
প্রশ্ন : শেষ পর্যন্ত সমালোচকরা আপনার কাজকে ভালো বলে স্বীকৃতি দেবে, এটা ভেবে কি আপনি তৃপ্ত?
কপোলা : আমি তৃপ্তি পেতাম যদি তারা এখন এই কথাগুলো বলত। আর আপনি যেটা বলছেন তার মানে হলো, আমি এখন যা করছি তার প্রশংসা শুনতে আমাকে আগামী ১০ বছর অপেক্ষা করতে হবে! আমার মনে হয় না, এতদিন অপেক্ষা করার মতো সময় আমার হাতে আছে!