‘এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়’
যে মাটির জন্য ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, যে মাটির মানুষের জন্য পরিচ্ছন্ন রাজনীতির উদাহরণ ছিলেন যিনি, তাঁর নিথর মরদেহ থাইল্যান্ড থেকে দেশে আনা হয় শনিবার সন্ধ্যায়। সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মরদেহ বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছায়।
পরে কফিনে মোড়ানো মরদেহ গ্রহণ করেন তাঁর ছোট ভাই সাফায়েত উল ইসলাম। এ সময় বরেণ্য এই রাজনীতিবিদকে দেখার জন্য বিমানবন্দরে ভিড় করেন তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, আত্মীয় স্বজনসহ সর্বস্তরের মানুষ। তাঁরা মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করেন। প্রিয় এই নেতার শোকে এ সময় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
সেখানে অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টাপরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম ও ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন সিরাজ ও এনামুল হক শামীম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া প্রমুখ বিমানবন্দরে উপস্থিত হন।
বিমানবন্দরে দোয়া ও মোনাজাত শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়। রাজনীতি অনেকেই করেন, কিন্তু এদেশের রাজনীতিতে ভালো মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। খুব বেশি ভালো মানুষ রাজনীতিতে নেই। এদের মধ্যে সৈয়দ আশরাফ একজন বিরল।’
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ পৌঁছালে সেখানে মোনাজাত করেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। ছবি : ফোকাস বাংলা
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘সব সময় আওয়ামী লীগের যুগসন্ধিক্ষণে, যেমন বিগত ১/১১ এর সময় যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমরা কারাগারে, এই সৈয়দ আশরাফই আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি আমি সশ্রদ্ধ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।’
বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বেইলি রোডের বাসায় আনা হয়। সেখানে আত্মীয়-স্বজনসহ সর্বস্তরের জনগণ ও নেতাকর্মীরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। এরপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরে।
আগামীকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় সৈয়দ আশরাফের প্রথম জানাজা হবে। এরপর হেলিকপ্টারে করে মরদেহ নেওয়া হবে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। দুপুর ১২টায় কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ময়দানে দ্বিতীয় জানাজা হবে। এরপর দুপুর ২টায় ময়মনসিংহের আঞ্জুমান ঈদগাঁহ মাঠে তৃতীয় জানাজার পর আশরাফুল ইসলামের মরদেহ ঢাকায় এনে আসরের পর বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তাঁর স্বজনরা।
শপথ নেওয়া হলো না
এবারো কিশোরগঞ্জ-১ আসনের মানুষ সৈয়দ আশরাফকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন। কিন্তু এলাকাবাসী আর লাখো কর্মী ও তাঁর মাঝে মৃত্যুই রেখা টেনে দিল। এবার তাঁর শপথ নেওয়া হলো না আর। স্বল্পভাষী, নিভৃতচারী সৈয়দ আশরাফ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি ছিলেন আলোকিত অথচ আড়ালের মানুষ।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেতাকর্মীদের কাঁধে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মরদেহ। ছবি : ফোকাস বাংলা
তিনি সেই তেজোদীপ্ত কিশোর আশরাফ, যিনি জীবন বাজি রেখে ১৯৭১ সালে হানাদারের বিরুদ্ধে ছিলেন মুক্তি বাহিনীর গর্বিত সৈনিকের কাতারে। তিনি তো সেই পিতার পুত্র যে পিতা এই দেশকে হানাদার মুক্ত করার সংগ্রামে ছিলেন অন্যতম সংগঠক, ছিলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্ম নেওয়া সৈয়দ আশরাফ পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রে ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। স্বাধীনতার পর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান।
১৯৯৬ সালে দেশে ফিরে কিশোরগঞ্জ সদর আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলকে গ্রেপ্তারের পর সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এবং পরে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ বেশকয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ তিনি ছিলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত এ সজ্জন মানুষ আর ফিরবেন না প্রিয় জনতার মাঝে।