সমাধান আপনার অভিভাবকত্বে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমের আলোচিত চরিত্র এখন রিফাত, মিন্নি ও নয়ন বন্ড। সঙ্গে আরো কয়েকজনের নাম আসছে। প্রথম খবর ছিল স্ত্রী প্রাণপন চেষ্টা করেও খুনিদের হাত থেকে স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি। খবর যখন এতটুকু ছিল, তখন রিফাতের স্ত্রী মিন্নির প্রতি সহানুভূতি, বাহ্বা আসতে থাকে। যখন তাদের বন্ধুদের দিক থেকে এই তিনজনের ত্রিভূজ সম্পর্কের প্রকাশ পেল, তখন পাল্টে গেল দৃশ্যপট।
রিফাতের হত্যার চিত্রনাট্য যেন মিন্নির তৈরি। প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ের সম্পর্কের টানাপড়েন তিনজনের মধ্যেই থাকতে পারে। মিন্নিকে ঘিরে দুজনের সম্পর্কের অবনতি ঘটাও হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই অবনতি হত্যা পর্যন্ত গড়াবে কেন? খুন সেটি প্রকাশ্যে বা আড়ালে যেভাবেই হোক, বরাবরই তা ঘৃণার এবং সর্বোচ্চ অপরাধ। ঘটনার দ্বিতীয় দিন গড়তে গড়াতেই জানা গেল যাদের আমরা ভেবেছিলাম সাধারণ মানুষ, বাধা না দিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে হত্যা প্রত্যক্ষ করেছে, তারা আসলে সাধারণ পথচারী নন। তারা ওদের সহপাঠী, বন্ধু বা একই সংগঠনের কর্মী। রিফাতের দিকে প্রথম হামলাটি নাকি তাদের দিক থেকেই এসেছে।
বরগুনা ছোট শহর। সরকারি কলেজের ছাত্ররাও শহরের মানুষের চেনা। যারা রাজনৈতিক সংগঠন করেন, তাদের অবয়বও শহরবাসীর মুখস্থ। সুতরাং নিজেরা দলবদ্ধ হয়ে যখন বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল, তখন আশপাশের মানুষেরা ভেবেছিল নিজেদের ভেতরকার কোনো ঘটনা নিয়ে এই বিবাদ এবং এত বড় একটি গ্যাঙকে এক-দুজনের বাধা দিতে আসাও সম্ভব ছিল না। ঘটনাটি পাঁচ-ছয় মিনিটে ঘটে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো একত্রিত হয়ে এই গ্যাঙের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোরও সময় পায়নি।
রিফাতকে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্যে। এমন হত্যার নজির এটিই প্রথম নয়। বৃহস্পতিবার ঠাকুরগাঁওয়েও একজন নার্সকে কুপিয়ে হত্যার খবর পাওয়া গেছে। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় নিজ ভাতিজার ক্ষোভের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি স্কুলপড়ুয়া কিশোর, কলেজপড়ুয়া উঠতি তরুণরা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তারা প্রথমে মাদকে আসক্ত হচ্ছে, তারপর যুক্ত হচ্ছে একের পর এক অপরাধের সঙ্গে। পরিবারের উদাসীনতা এবং অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা অপরাধের অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। এই ডুবে যাওয়ার আরেক অবলম্বন হচ্ছে রাজনীতি। গ্রামে শহরে কৈশোর –তারুণ্যের বড় একটি অংশ ব্যবহৃত হচ্ছে নষ্ট রাজনীতি দ্বারা। ক্ষমতা ব্যবহারের তাৎক্ষণিক তাপ ও লোভে সহজেই মাদক, মোটরসাইকেল এবং কয়েকটি টাকায় কৈশোর-তারুণ্যের শক্তিকে কিনে নিচ্ছে রাজনীতি। এই বিক্রি হয়ে যাওয়া কিশোর-তরুণরা এক সময় নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে কিংবা রাজনীতির বিরোধের ঢাল তলোয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমরা এমন উদাহরণ দীর্ঘ দিন ধরে দেখে আসছি। এই প্রবণতাটি রাজধানী ও বড় শহরে প্রায় দেখা গেলেও, গ্রাম ও ছোট শহরে দেখা যেত কদাচিৎ। কিন্তু এখন সব জায়গাতেই হরদম এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যারা এমন অপরাধ ঘটাচ্ছে, তাদের সবাই বিচারের আওতায় আসছে না। মামলা হলেও সেই জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে নানা ফন্দি ফিকির করে। এই যে বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তা থেকেই অন্যরা অপরাধ ঘটানোর সাহস সঞ্চয় করছে। রিফাত, রতন বন্ডের মধ্যকার বিরোধ এবং পরবর্তীতে কুপিয়া হত্যা এসবেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার বটিকা একটাই- পারিবারিক নজরদারি। অভিভাবকরা যদি সন্তানের গতিবিধির দিকে নজর দেন, সন্তানের বন্ধু কে বা কারা? সন্তানের কাছে অর্থের জোগান আসছে কি করে? পড়ালেখার বাইরে কোথায় কেমন করে সময় কাটায়। সন্তান রাজনীতি বা যেকোনো সংগঠন করতেই পারে।তার জীবন গঠনের জন্য সংগঠন করা জরুরি। কিন্তু সেই সংগঠনের সঙ্গে সে কেমনভাবে যুক্ত। শুদ্ধ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক চর্চা সে করছে কি না? এই দিকগুলো নজরে রাখলে, বাজি ধরে বলা যায় রিফাতের মতো কাউকে এমন নির্মম হত্যার শিকার হতে হবে না। রাষ্ট্র বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিক, আর আপনার দিক থেকে শুরু হোক দায়িত্বশীল অভিভাবকত্ব।
লেখক : বার্তাপ্রধান, সময় টিভি