এরশাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন
সেনাপ্রধান থেকে সামরিক শাসক, রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, অতঃপর বিরোধীদলীয় নেতা। দীর্ঘ সামরিক ও রাজনৈতিক জীবনে বহুল আলোচিত-সমালোচিত অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম নানা কারণে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিজের রাজনৈতিক অভিলাষের যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এই সামরিক শাসক।
সামরিক বাহিনীতে এরশাদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৫২ সালে অফিসার পদে যোগদানের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সপ্তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক এরশাদ অবস্থান করছিলেন পাকিস্তানে। দেশে ফেরেন ১৯৭৩ সালে। ফিরেই পদোন্নতি পেয়ে হন কর্নেল। এর দুই বছর পরই হন ব্রিগেডিয়ার। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সময় ভারতে একটি প্রশিক্ষণে থাকা এইচ এম এরশাদ মাত্র তিন মাসের মাথায় মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি ও উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন এরশাদকে। এক বছর পর সেনাপ্রধান এরশাদ পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রকাশ পেতে থাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার বাসনা। ক্ষমতা দখলের পর ১৯৮২ সালে আবুল ফজল মোহাম্মদ আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করার বছর পার হতেই আহসানউদ্দিনকে অপসারণ করে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন সামরিক শাসক এরশাদ। তারপর ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতার সম্প্রসারণ করেন এরশাদ। ওই বছরই গঠন করেন নিজের দল জাতীয় পার্টি।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই এই স্বৈরশাসকের পতনে একাট্টা হয় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল। ’৮৬ ও ’৮৮ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিস্থিতি আরো ঘোলা করে তোলে। ধীরে ধীরে চরম আকার ধারণ করে এরশাদবিরোধী আন্দোলন। ডা. মিলন, নূর হোসেনসহ অনেকের রক্তে চূড়ান্ত রূপ পায় স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে পতন হয় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এরশাদের।
১৯৯১ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই কারান্তরীণ হন এরশাদ। মেজর জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলাসহ অনেক দুর্নীতি মামলায় শুরু হয় তাঁর বিচার। ছয় বছর কারাভোগের পর তাঁর রাজনৈতিক পুনর্বাসন শুরু হয় ১৯৯৭ সালে।
২০১৪ সালে তাঁর দল জাতীয় পার্টি প্রথমবারের মতো হয় সংসদের বিরোধীদল। প্রথমবারের মতো তিনি হন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর সর্বশেষ নির্বাচনেও বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসে জাতীয় পার্টি। একসময়ের রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বসেন বিরোধীদলীয় নেতার আসনে।
ক্ষমতা ছাড়ার পর এরশাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্যে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এরশাদের অনুসারীরা মনে করেন, সাবেক এই রাষ্ট্রপতি দেশের উন্নয়নে নিবেদিত ছিলেন ক্ষমতা থাকাকালীনও। সার্ক বাস্তবায়ন, উপজেলা পরিষদ গঠন, মহুকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর, যোগাযোগ ও অবকাঠামোর উন্নয়নে এরশাদের ভূমিকার উদাহরণ দেন তাঁরা। উপজেলা পরিষদ গঠনের কারণেই পল্লীবন্ধু উপাধি পান এই সামরিক শাসক।
রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়ার পর দীর্ঘ ৩০ বছর রাজনৈতিক ময়দানে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এরশাদ পরিষ্কার করতে চেয়েছেন নিজের অবস্থান। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৮৬ সালের পরে একদিন থাকলেও আমি রাষ্ট্রপতি। এটা বৈধ, এটা অবৈধ থাকতে পারে না। কোর্টের রায় আছে।’
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে টেলিভিশনের টক শোতে দিয়ে গেছেন নিজের দর্শন। এক বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বলেছিলাম নির্বাচিত প্রতিনিধি দেওয়ার। আমরা যাঁরা সংসদে আছি নির্বাচিত, তাঁদের নিয়ে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হোক। সেই সরকারের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হোক নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য।’
মুহূর্তে মুহূর্তে নিজের মত যেমন পাল্টিয়েছেন, পাল্টেছেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও। গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হয়েছে তাঁর দল জাতীয় পার্টি।
ব্যক্তিজীবনে এরশাদের প্রথম স্ত্রী হিসেবে রয়েছেন রওশন এরশাদ। পরে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন বিদিশার সঙ্গে। রয়েছে দুই ছেলে সাদ ও এরিক এরশাদ। ১৯৩০ সালে রংপুরের দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন সাবেক সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।