চলে গেলেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ
ভারতের রাজনীতিতে তৈরি হলো বড়সড় শূন্যতা। চলে গেলেন সাবেক কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে দিল্লির এইমসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হয় সুষমা স্বরাজের। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। জানা গেছে, বুকে ব্যথা হওয়ায় মঙ্গলবার রাত ৯টা নাগাদ সংকটজনক অবস্থায় তাঁকে দিল্লির এইমস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হাসপাতালে ভর্তির পর হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। কিন্তু চিকিৎসকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাঁকে বাঁচাতে পারেননি। সুষমার মৃত্যুতে ভারতজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। জানা যায়, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ২৩ মিনিটে সর্বশেষ টুইট করেন তিনি। তারপরেই সুষমার শরীর খারাপ হতে শুরু করে। তড়িঘড়ি তাঁকে দিল্লির এইমস হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন এবং পরে পৌঁছে যান আরেক বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহনমন্ত্রী নীতিন গড়করি।
সুষমা স্বরাজ ছিলেন ব্যক্তিজীবনে তুখোড় আইনজীবী ও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। সেইসঙ্গে ছিলেন সুগৃহিণীও। সব ক্ষেত্রেই সফল তিনি। সুষমা স্বরাজের জীবনের বেশির ভাগটাই কেটেছে রাজনীতির আঙিনায়। ভারতের প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পর তিনি একমাত্র নারী, যিনি ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে। তবে এবারের লোকসভা নির্বাচনের শুরুতেই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ২০১৯ সালের ভোটে লড়বেন না।
ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএসের) সদস্য হরদেব শর্মা এবং লক্ষ্মীদেবীর বড় মেয়ে ছিলেন সুষমা স্বরাজ। হরিয়ানার আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের মেয়ে তিনি। সেখানকার সনাতন ধর্ম কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। তারপর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার সঙ্গে এনসিসি, শাস্ত্রীয়সংগীত, আবৃত্তি, নাটক, ফাইন আর্ট, সাহিত্যচর্চাও করতেন। বিতর্ক, আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় সব সময়ই সেরা ছিলেন তিনি। সুষমা স্বরাজের বোন বন্দনা, ভাই গুলশন। তবে এরা কেউই রাজনীতিতে নেই। কিন্তু সুষমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি ছাত্রাবস্থায়। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে পা রাখেন তিনি। সেইসঙ্গে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান।
১৯৭৩ সাল। কালো কোট গায়ে সুপ্রিম কোর্টে ঢুকলেন সুষমা। শুরু হলো আইনজীবীর জীবন। কয়েক বছরের মধ্যেই সোশ্যালিস্ট নেতা জর্জ ফার্নান্দেজের লিগ্যাল ডিফেন্স টিমে যোগদান করেন তিনি। সেখানেই পরিচয় স্বরাজ কৌশলের সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনী চিনতে ভুল হয়নি স্বরাজের। দেশে তখন জরুরি অবস্থা। পরিবেশ থমথমে। তখনই চার হাত এক হলো স্বরাজ-সুষমার। জরুরি অবস্থার পর সুষমা যোগ দিলেন বিজেপিতে। তত দিনে আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত স্বরাজ; রাজনীতিতেও। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মিজোরামের রাজ্যপাল ছিলেন স্বরাজ। সাংসদ ছিলেন ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত।
স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিলেন সুষমাও। সংসার সামলানোর সঙ্গেই রাজনৈতিক জগতের একের পর এক সিঁড়ি টপকাতে শুরু করেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত হরিয়ানা বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন সুষমা। বয়স তখন ২৫ বছর। ১৯৭৭ সালেই ক্যাবিনেট মন্ত্রী হন। ২৭ বছর বয়সে হরিয়ানা বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সুষমাই ছিলেন হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী। ১৯৯০ সালে জাতীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। আসেন রাজ্যসভায়। ১৯৯৬ সালের লোকসভায় দক্ষিণ দিল্লি থেকে জয়ী হন সুষমা স্বরাজ।
ভারতের প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ির জমানায় কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সুষমা। দুই বছরের মধ্যেই টেলিকম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। সেখানেও সফল হন সুষমা। ভারতের মাটিতে ফিল্ম প্রোডাকশনকে ‘ইন্ডাস্ট্রি’র মর্যাদা দেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু করেন কমিউনিটি রেডিও। ১৯৯৮ সালে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী করা হয় সুষমাকে। ইস্তফা দিতে হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্বে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে অবশ্য খুব বেশি দিন ছিলেন না সুষমা। বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের পর ফের ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে কর্ণাটকের বেল্লারি কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী হিসেবে সুষমাকে ময়দানে নামানো হলো কংগ্রেসের ‘হেভিওয়েট’ প্রার্থী সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে। তবে সুষমা জিততে পারেননি। কিন্তু কংগ্রেসের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সহজে হার মানার পাত্রী তিনি নন। ২০০০ সালের এপ্রিলে উত্তরপ্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হলেন সুষমা। ২০০৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দক্ষ হাতে স্বাস্থ্য, পরিবারকল্যাণ এবং সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মধ্যপ্রদেশ, ওডিশা, রাজস্থান, বিহার, ছত্তিশগড় ও উত্তরাখন্ডে এইমস তৈরির কৃতিত্ব তাঁরই। ২০০৬ সালে ফের রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন মধ্যপ্রদেশ থেকে।
২০০৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার বিরোধী দলের ডেপুটি লিডার হন। সে বছর লোকসভা ভোটে মধ্যপ্রদেশের বিদিশা কেন্দ্র থেকে জিতে এলেন সুষমা স্বরাজ। নিজের যোগ্যতায় বিজেপির তাবড় তাবড় নেতার সারিতে নিজের জায়গা করে নিলেন। ২০১৪ সালে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে সুষমার নাম নিয়েও গুঞ্জন উঠেছিল। তবে ভোটে জেতার পর মোদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন তিনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ্যতার ছাপ রাখার পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ছলেন সুষমা স্বরাজ। আকস্মিকতার মৃত্যুতে ভারতের রাজনৈতিক মহলের পাশাপাশি সর্বস্তরে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।