গপ্পো তক্ক যুক্তি
গল্পের অবশ্যই ভোগান্তি থাকতে হবে : ডেভিড লিঞ্চ
ডেভিড কিথ লিঞ্চ। ১৯৪৬ সালের ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানায় জন্ম তাঁর। সিনেমা তাত্ত্বিকদের কাছে যাঁর পরিচয় ‘মাস্টার অব রিডিক্যুল’ নামে। ডেভিড লিঞ্চের ছবি একবার নয়, বারবার দেখেও শেষটায় কী হলো কিছুই বুঝতে না পারা একটি স্বাভাবিক ঘটনা। উদ্ভট, বিচিত্র, নৃশংস অথচ অসামান্য শৈল্পিক আর নিখুঁত এই অসামান্য নির্মাতার প্রতিটি কাজ। তাঁর ‘ব্লু ভেলভেট’, ‘মালহোল্যান্ড ড্রাইভ’, লস্ট হাইওয়ে’, ‘ইরেজারহেড’, ‘টুইন পিকস : ফায়ার ওয়াক উইথ মি’, ‘ইনল্যান্ড এম্পায়ার’ ছবিগুলো তুমুল জনপ্রিয়। নব্বইয়ের দশকে টেলিভিশন সিরিয়াল ‘টুইন পিকস’ পরিচালনা করেও ব্যাপক প্রশংসিত হন এই পরিচালক। এ নিয়ে এখন চলছে তুমুল আলোচনা। এই সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তর করা হয়েছে ‘দ্য টকস’ থেকে।
মিস্টার লিঞ্চ, আপনার মেজাজ চড়া বলে কি আপনি মেডিটেশন রপ্ত করেছিলেন?
না। আমি টের পেয়েছিলাম যে আমার রাগারাগির সমস্যা আছে। এ সমস্যা অনেকের থাকে। আমি তাদেরই একজন। মানুষ এমন সব লোকজনের ওপর রাগ ঝাড়ে, যাদের কাছ থেকে তারা সহজে পার পেতে পারে- আমার পরিবর্তনটা টের পেয়েছিল আমার প্রথম স্ত্রী। যেটা ঘটেছিল- আমি দু সপ্তাহ ধরে ধ্যান করছি, মানে মেডিটেশন আর কি! সে একসময় আমার কাছে এলো এবং বলল, ‘এসব কী হচ্ছে?’ আমি বললাম, তুমি কী বোঝাতে চাইছো? তখন সে বলল, ‘কোথায় সেই রাগ?’ সে আর কখনোই ‘সেই’ রাগ দেখতে পায়নি! অধিকাংশ সময়েই মানুষজন মেডিটেশনের পর তাদের যে বদলটা আসে, সেটা টের পায় না, যতক্ষণ না তাদের আশপাশের কেউ সেটা ধরিয়ে দেয়। অন্য মানুষই তাদের মধ্যে পরিবর্তন বুঝতে পারে।
আপনি তাহলে মেডিটেশন শুরু করলেন কেন?
আমি শুরু করেছিলাম ১৯৭৩ সালে। ধারণাটা ছিল এ রকম যে, মানুষ চাইলে অনেক কিছু জানতে পারে। এই ধারণাই আমাকে খ্যাপাটে করে তুলেছিল, কারণ আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন যে আমরা আমাদের মগজের মোটে ৫ বা ১০ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারি। তবে বাকিটুকু কিসের জন্য? আপনি আরো কতটা পেতে পারেন, আরো কতটা? আর আপনার পক্ষে সর্বোচ্চ কতটুকু পাওয়া সম্ভব? অনেকে বলেন যে মেডিটেশন হলো জগিংয়ের মতো, কিংবা সূর্যালোকে কোন সমুদ্রসৈকতে শুয়ে থাকবার মতো। এগুলো আসলে মেডিটেশন বিষয়ে একদম ভুলভাল ধারণা। মেডিটেশন হচ্ছে সমস্ত বাঁধা পেরিয়ে এগোবার রাস্তা, জীবনের গভীরতম অংশে প্রবেশের পথ, শ্রেষ্ঠত্ব, খাঁটি, সামগ্রিকত্ব এবং প্রকৃত বাস্তবতা। এর স্বাদ নিলে মনে যায়, মানুষ এর জন্যই বুঝি তৈরি হয়েছে।
আপনার ছবিগুলোর চেতনাস্তরের মাত্রা অনেক উঁচু। এ কারণে কি আপনি নিজেকে বড়মাপের শিল্পী মনে করেন?
আমি ঠিক বলতে পারব না। আপনি যখন মেডিটেশনের গভীর স্তরে পৌঁছাবেন, তখন চাইলে অনেক আইডিয়া ধরতে পারবেন চট করে। ইনট্যুইশন বেড়ে যাবে, আর ইনট্যুইশন হলো একজন শিল্পীর জন্য সবচেয়ে দরকারি সরঞ্জাম-একই সাথে ভাবা আর অনুভব করার বিষয়টা। আপনি যখন একটা পেইন্টিং নিয়ে কাজ করবেন, তখন আপনি বিষয়টাকে চেনেন, আর সেটা করতেও আপনার খুব ভালো লাগবে। ফিল্মের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। কাজের আনন্দ যত বাড়ে, সবকিছুরই আনন্দ ততটা বেড়ে যায়। আইডিয়া তখন স্রোতের মতো আসে, আর তখন অনুভূতিটাও এমন হয় যে আপনি এটাকে ঠিকঠাক বুঝতে পারছেন আপনার মতো করে। আপনি জানেন যে বিষয়টা আসলে কি! এই বুঝে ওঠাটা বাড়তে থাকে। এ যেন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি!
আপনার কি এখনো মাঝেমধ্যে আপসেট লাগে, বা ডিপ্রেশনে ভোগেন সময় সময়?
ডিপ্রেশন বা ঘৃণার ঢেউ আপনাকে যেকোনো সময়েই ধাক্কা দিতে পারে। এগুলোর সবকিছুই একটা আরেকটার সাথে সম্পৃক্ত। শুধু মাত্রা ক্রমশ কমতে থাকে, কমতেই থাকে। সুতরাং ভোগান্তিও আস্তে আস্তে কমে যায়। আমাদের জন্ম তো ভোগান্তির জন্য নয়। আমাদের সৃষ্টি উপভোগের জন্য। আমাদের সুখী থাকার কথা। আর সুখী থাকাও পুরোপুরি সম্ভব। যেকোনো কাজে প্রকৃতি শান্তি আর আনন্দ পাওয়ার কথা। এর এটা কাজের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে, বেঁচে থাকার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, যখন আপনি আনন্দটা উপভোগ করতে পারবেন তখন জীবনস্পৃহা আরো তীব্র হয়ে উঠবে।
এই বিষয়টা আপনার নিত্যদিনের জীবন কীভাবে প্রভাবিত করে, বিস্তারিত বলবেন কি?
আপনার প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন বিষয়গুলো একই থাকে, বদলায় না। কেবল আপনি কীভাবে তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সেটাই এগুলোকে আরো মজাদার করে তোলে। আমার ‘ডিউন’ ছবিতে এ বিষয়টা আমাকে একেবারে শেষ করে দিতে ধরেছিল! পুরো বিষয়টাই ছিল আতঙ্কদায়ক। আমার ছবিগুলো দিয়ে আমি অনেক কিছুই ধরতে পেরেছি-আমি জানি যে আমি আমার সবটাই দিয়ে দিয়েছি। এ অবস্থায় আমি হয়তো ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তাম, কিন্তু আমাকে বাঁচিয়েছে মেডিটেশন। একটা কথা আছে : তুমি যেমন, পৃথিবীও তেমন। আপনি একটা কটকটে সবুজ রঙা চশমা পরুন, দেখবেন দুনিয়া সেটার মতোই দেখাচ্ছে! কিংবা ঝাঁপ দিন মুক্ত হয়ে, চেতনাস্রোতের অপূর্ব আর অসীম সাগরে, সৃষ্টিসুখে, জ্ঞানে-এসব উপকারী বিষয়ে; দেখবেন, আপনি কখন যেন গোলাপরঙা গ্লাস পরতে শুরু করে দিয়েছেন। দেখবেন দুনিয়াও আপনার দিকে ঠিক তেমন করেই চেয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি দিন দিন আরো ভালো হতে থাকবে।
আমি কিন্তু বলব যে আপনার ছবিগুলো দেখলে মনে হয় যে এগুলো পৃথিবীকে দেখে একটা অন্ধকার গ্লাসের ভেতর দিয়ে। কেন এমন হয়?
আপনি যদি এমন একটা ছবি দেখেন যার শুরুটা শান্তিময়, মাঝের দিকটাও শান্তিময় এবং শেষটায় শান্তিময়- তাহলে এটা আসলে কেমন গল্প? কোনো গল্প বলতে হলে তার মধ্যে আপনার অবস্থা বুঝে সংঘাত মেশাতে হবে। কাহিনীর মধ্যে আলো আর অন্ধকার থাকতে হবে, বিশৃঙ্খলা থাকতে হবে-থাকতে হবে সবকিছু। কিন্তু তার মানে এই নয় যে চলচ্চিত্রকারকেও এই ভোগান্তি দেখানোর জন্য নিজেরই ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। গল্পের অবশ্যই ভোগান্তি থাকতে হবে, মানুষের নয়।
কোনো ছবির জন্য আপনার মাথায় আইডিয়া কীভাবে আসে?
আমি সব সময়েই বলি যে আইডিয়াগুলোই আপনার নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবে। আইডিয়া এক বিশাল আশীর্বাদ। আইডিয়া হলো এমন একটা জিনিস যা আপনি আসলে ধরবার চেষ্টা করছেন, আপনি যার প্রেমে পড়ে গেছেন। আমার ছবিগুলোর ক্ষেত্রে ঘটনা ঠিক এমন। কোনো বইপত্র বা বা অন্য কারো চিত্রনাট্য থেকে নয়, পুরো বিষয়টা আসে আইডিয়া থেকে। পুরো বিষয়টা একবারে মাথায় আসে না, ভেঙে ভেঙে আসে। এই ছোট ছোট অংশগুলো নিজেরাই একটা স্ক্রিপ্ট বানিয়ে ফেলে। আপনার আইডিয়াটা জাস্ট লিখে ফেলুন আর পরেরটা আসার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকুন। ওগুলো ধীরে ধীরে নিজেরাই একটা স্ক্রিপ্ট বানিয়ে ফেলবে। সেটাই হচ্ছে গোছানো আইডিয়া। তারপরের কাজটা হলো গিয়ে সেই স্ক্রিপ্টটা শুট করে ফেলতে হবে, তারপরে এডিট করতে-শেষটায় সাউন্ড-মিউজিক ঠিকমতো জুড়ে দিতে হবে। এটা একটা প্রক্রিয়া। একটা আইডিয়া আপনাকে এমন একটা ছবি দিতে পারে, যা খুবই বিমূর্ত আর মোটেও সোজাসাপ্টা নয়, আবার এমন ছবিও দিতে পারে যা একেবারেই সোজাসাপ্টা।
আপনি কোনটা প্রেফার করেন?
আমার সিনেমার সব ধরনের বৈচিত্র্যই ভালো লাগে। এখানে কোনো সূত্র নেই, নীতি নেই। কিছু কিছু বিমূর্ত বিষয় আমাকে একটুও আলোড়িত করে না, আবার কিছু কিছু তো আমাকে পুরোই পাগল করে দেয়! কিছু সোজাসাপ্টা ছবি আমাকে একটুও নাড়ায় না, আবার কিছু কিছু আমাকে পুরোদমে জাগিয়ে দেয়! এ হলো সিনেমা, এতে বিলিয়ন বিলিয়ন উপাদান আছে। অনেকে বলেন যে সিনেমায় শিল্পকলার সাতটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে। সিনেমা একদম পরিপূর্ণ এক মাধ্যম, কাজেই এটি আপনাকে কোনদিকে যাওয়ার জন্যই কখনো আটকাবে না; যদি আইডিয়াগুলো ঠিকঠাক এসে পড়ে। সিনেমা হচ্ছে এক বিশেষ, সাহসী আর অপূর্ব মাধ্যম।
কোনো ছবিকে কি আপনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন?
সবারই নিজের আওয়াজ খুঁজে পাওয়া দরকার। এটা নেহাত কপি করার মতো কিছু নয়। তবে গদার, ফেলিনি আর বার্গম্যান ছিলেন আমার নায়ক। ‘সানসেট বুলেভার্ড’, ‘রিয়ার উইন্ডো’, ‘৮ ১/২’ , জ্যাক তাতির ‘মাই আঙ্কল’ অথবা ‘মসিয়ে হুলো’স হলিডে’, ‘রিয়ার উইন্ডো’, কুব্রিকের সমস্ত ছবি, ফেলিনির সমস্ত ছবি, সম্ভবত বার্গম্যানেরও সব ছবি- অনেক ছবি আছে যেগুলো আমার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছে।
এই ছবিগুলো কি অবচেতনভাবে আপনার কাজে প্রভাব ফেলেছে? যেমন চট করে কেউ বলতে পারেন যে ‘ব্লু ভেলভেট’ এ ভয়্যারিজমের বিষয়টা ‘রিয়ার উইন্ডো’ থেকে অনুপ্রাণিত-উদাহরণের জন্য বলা আর কি।
এটা হতে পারে, আমার জানা নেই। সিনেমার সময় পেরিয়েছে ১০০ বছরের বেশি, কাজেই আমাদের যে কারো জন্য এমন একটা ছবি বানানো খুবই কঠিন যেটা অন্য কোনো ছবির সাথে একেবারেই মেলানো যাবে না। আমার কাছে ‘ব্লু ভেলভেট’ হলো ‘ব্লু ভেলভেট’, ‘রিয়ার উইন্ডো’ হলো ‘রিয়ার উইন্ডো’। আপনি এটা বলতে পারেন যে ‘সানসেট বুলেভার্ড’ বা ‘রিয়ার উইন্ডো’ আমার জন্য আইডিয়া নিয়ে এসেছে। তবে আমি ওগুলোকে যতই ভালোবাসি বা অনুপ্রাণিত হই না কেন, জীবন তো ২৪x৭ রানটাইমের একটা ছবি। সেখান থেকেই অনবরত আইডিয়াগুলো আসতে থাকে। সিনেমাই আসলে আইডিয়া দেয় বা আইডিয়াগুলো জুড়ে দেয়, এটা বলা কঠিন। সবকিছুই একটা আরেকটার সাথে সম্পৃক্ত।
বিলিয়ন বিলিয়ন আইডিয়া চারপাশে সাঁতরে বেড়াচ্ছে, আপনার শুধু ওগুলোকে খপ করে ধরতে হবে,ব্যস!