অপরাধ কমতে শুরু করেছে ছিটমহলে
এত দিন প্রায় সব ধরনের আইনি ও পুলিশি সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল লালমনিরহাটের ছিটমহলের মানুষ। ভারতের অংশ বলে এখানকার কোনো অভিযোগ আমলে নিত না বাংলাদেশের পুলিশ। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একেকটি ছিটমহল পরিণত হয়েছিল অপরাধী ও মাদক ব্যবসায়ীদের 'অভয়ারণ্যে'। তবে স্থলসীমান্ত চুক্তির পর উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে শুরু করেছে অপরাধের হার।
গত বছর শেষ দিকে হত্যা করা হয় গৃহবধূ সেলিনাকে। হত্যার পর পুরো ৩৮ ঘণ্টা পড়ে ছিল সেলিনার লাশ। সেলিনা বাংলাদেশি হলেও তার স্বামী ভারতের অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দা তাই এ মৃত্যুর বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পাটগ্রাম থানার পুলিশ। একপর্যায়ে তাঁর লাশ নিয়ে পাটগ্রাম থানায় যায় ছিটমহলবাসী। এরপর লালমনিরহাট এবং পরে বিএসএফের কাছে লাশ হস্তান্তর করতে পার হয়ে যায় ১৯ দিন। এ সময় অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে সেলিনার স্বামী রুবেল। কতটা অসহায় ছিটমহলের মানুষ, তারই জ্বলন্ত উদাহরণ লালমনিরহাটের পাটগ্রামের ভোটপাড়া ছিটমহলের সেলিনার ঘটনা।
এ ছাড়া অসংখ্য অপরাধের কথা শোনা গেলো ছিটমহলবাসীর কাছ থেকে। দিন যায়, রাত আসে; কিন্তু আতঙ্ক কাটে না। মানুষ হয়েও আইনি প্রতিকার পাওয়ার কোনো অধিকার নেই এদের। এনটিভির সঙ্গে নাম-পরিচয় গোপন করে কথা বলেন কয়েকজন ছিটমহলবাসী।
প্রতিদিন ঘটে যাওয়া বিভিন্ন হেনস্তার কথা বলতে গিয়ে এক পুরুষ বললেন, ‘ধরা যাক, একটা থানায় আমি কাজের জন্য গেলাম, কাজ হবে না। ছিট কোনোদিন বলিই নাই। যদি বলে যে বাড়ি কোন জায়গায়, বাংলাদেশের মধ্যে।’
আরেকজন জানালেন, এসব মেনে নিয়েই ভয়ের ভেতর বাস করতে হয় তাদের। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের বিচার নেই, তো ভয় তো অবশ্যই পাওয়া লাগবে। আরো তো বাল বাচ্চা আছে।’
urgentPhoto
অপরাধী আর মাদক ব্যবসায়ীদের বড় আশ্রয়স্থল ছিটমহলগুলো। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মাদকের প্রথম গন্তব্য ছিটমহল। এরপর সুযোগ বুঝে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আর নির্বিঘ্নেই এ অপরাধ চলছে বছরের পর বছর। কারণ অপরাধীরা জানে, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের পুলিশ আসবে না। তবে স্থল সীমান্ত চুক্তির পর থেকে বদলাতে শুরু করেছে পরিস্থিতি।
এ প্রসঙ্গে ছিটমহলের কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ আলী পোদ্দার রতন বলেন, ‘এখানে যেহেতু পুলিশের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। বিজিবি এখানে আসতে পারত না। সে কারণে এটা একটা মাদকের মজুদ-ভাণ্ডার ছিল। ঘোষণা হওয়ার পর পর, আগে যেমন এটা যত্রতত্র হতো, এখন সেটা আর নাই।’
আহমেদ আলী আরো জানান, এখানে আগে জমির পর জমিতে গাঁজার চাষ হতো। কিন্তু এখন এটা হচ্ছে না। চুক্তির ফলে যারা গাজা চাষ করত তারা ভয় পাচ্ছে। এছাড়া যারা এখন স্থল সীমান্ত চুক্তির বিরোধিতা করছে তারা চোরাকারবারি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাবেক এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, চোরাকারবারিরা দীর্ঘদিন ধরে নির্বিঘ্নে এই এলাকায় ব্যবসা করছে, এই এলাকাকে ব্যবহার করছে। কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন করার পর এখানে বাংলাদেশের পুলিশ আসবে, আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। এতে তাদের ব্যবসার ক্ষতি হবে, তাই তারা চুক্তির বিরোধিতা করছে।
ইন্দো-বাংলাদেশ ছিটমহল সমন্বয় কমিটির বাংলাদেশ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা এনটিভিকে বলেন, ‘ছিটমহলগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা জোরদারের যে ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ ছিটমহলগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশও পায়নি আবার ভারতও ছাড়েনি। এখন এখানে একটা ক্রান্তিকাল চলছে।’ তিনি আরো জানান, এই সময়ের মধ্যে অনেক সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি জমি দখল করতে পারে। কিংবা সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন মিথ্যা কথা বলে ভোলানোর চেষ্টা করতে পারে। অনেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে নিজেকে ছিটমহলের বাসিন্দা বলে দাবি করতে পারে। তাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো বাড়াতে হবে।
ছিটমহলবাসী বলছে, দীর্ঘদিন ধরে তারা অনেক সহ্য করেছে। এবার একটি দেশের নাগরিক হিসেবে সব নাগরিক অধিকার নিয়েই বাঁচতে চায় তারা। আর সেজন্য চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে তাকিয়ে আছে ভুক্তভোগী এই মানুষগুলো।