মুজাহিদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিল মামলায় আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপক্ষে এটর্নি জেনারেল যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করার কিছুক্ষণ পর আদালত মুলতবি করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আগামীকাল এ বিষয়ে আবার যুক্তি উপস্থাপন শুরু হবে।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
আজ মঙ্গলবার শুনানির অষ্টম দিনে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন মুজাহিদের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের রায় ও রায় সংক্রান্ত নথিপত্র পাঠ শেষ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন অপর আইনজীবী এস এম শাহজাহান।
আসামীপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনকালে অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘ট্রাইবুনালের দেওয়া রায় পর্যালোচনা করে আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন অভিযোগে সাক্ষীরা যেসব সাক্ষ্য দিয়েছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর ওপর ভিত্তি করে একজন আসামীকে সাজা দেওয়া যায় না। যে দুটি অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে একটি ৭ নং অভিযোগ বকচর গণহত্যার ঘটনা। ট্রাইবুনালে প্রসিকিউশন যখন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন, তখন এর মধ্যে ৭ নাম্বার অভিযোগটি ছিলই না। এ ছাড়া আদালতও তখন এটাকে আমলে নেয়নি এবং এই অভিযোগের সাক্ষীকে তদন্ত কর্মকর্তা পরীক্ষাও করেননি।’
প্রসিকিউশন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেননি দাবি করে খন্দকার মাহবুব হোসেন আরো বলেন, ‘মামলাটিতে পুলিশের তদন্তের কর্মকর্তা সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছেন, মুজাহিদ আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। তাঁর দায়িত্বে অপরাধ হয়েছে -এমন কোনো তথ্য প্রমাণ করতে পারেনি প্রসিকিউশন।’
অভিযুক্তের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কথা উল্লেখ করে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে স্বাধীনতার সময় তাঁরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। যে ১৭৫ জন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে (পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো সাজা দেওয়া হয়নি। প্রধান আসামিদের সাজা না দিয়ে দালালদের সাজা দেওয়া আইন বহির্ভূত।’
মুজাহিদ কোনো হত্যা বা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছেন, তা প্রমাণ করা যায়নি বলেও উল্লেখ করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তা ছাড়া ‘বেনিফিট অব ডাউট আসামিই পেয়ে থাকেন’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, মুজাহিদ ন্যায়বিচার পাবেন এবং আপিল বিভাগে খালাস পাবেন।’
আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি মুজাহিদের বিরুদ্ধে ১ নম্বর অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। এর কিছুক্ষণ পর আদালত আগামীকাল পর্যন্ত মুলতুবি করা হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল আগামীকাল এ বিষয়ে পুনরায় যুক্তি উপস্থাপন করবেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করেন। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ১১ আগস্ট আপিল করেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনালের পুরো রায়ের বিরুদ্ধে ১১৫টি যুক্তি নিয়ে আপিল করেন মুজাহিদ। ট্রাইব্যুনাল যেসব কারণে সাজা দিয়েছেন, তার আইনগত ও ঘটনাগত ভিত্তি নেই বলেও দাবি করেন তিনি।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে মোট সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। বাকি দুটি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ। একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের ঘটনায় ২০১১ সালের ২১ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন কর্মকর্তারা। এরপর ২ আগস্ট তাঁকে ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত বছরের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
এরপর ২৬ আগস্ট শাহরিয়ার কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এরপর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাকসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। অন্যদিকে মুজাহিদের পক্ষে প্রথম এবং একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তাঁর ছোট ছেলে আলী আহমেদ মাবরুর। গত ২২ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলে আসামিপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৫ মে দিন ধার্য করে দেন ট্রাইব্যুনাল। উভয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত ৭ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত মোট চার দিবসে মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে ১ নম্বর অভিযোগে ছিল, শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যা ও ৬ নম্বর অভিযোগে ছিল আলবদরের দায়িত্বে থাকা নেতা হিসেবে গণহত্যা সংঘটিত করা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়ন ইত্যাদির ঘটনা। প্রথম অভিযোগে শহীদ সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যার ঘটনায়ও তাঁর ভূমিকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয় রায়ে। ৭ নম্বর অভিযোগে ছিল, ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যার ঘটনা। এসব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে মুজাহিদকে ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এসব অভিযোগ প্রসিকিউশন সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণ করতে পেরেছেন বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রমাণিত ৫ নম্বর অভিযোগে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরনো এমপি হোস্টেলে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দায়ে মুজাহিদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া প্রমাণিত ৩ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার (রথখোলা) মৃত রমেশ চন্দ্র নাথের পুত্র রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক ও নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন মুজাহিদ।
অন্যদিকে প্রমাণিত না হওয়া ২ নম্বর অভিযোগ ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানায় বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও গণহত্যা এবং ৪ নম্বর কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার মো. আবু ইউসুফ পাখিকে আটক ও নির্যাতনের অভিযোগ থেকে খালাস পান মুজাহিদ।