কেন আমেরিকায় এলাম : তসলিমা নাসরিন
গত ২৭ মে নিরাপত্তা শঙ্কায় ভারত ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান লেখিকা তসলিমা নাসরিন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া নিয়ে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারে তিনি লিখেছেন, ‘কেন আমেরিকায় এলাম’।
তসলিমা নাসরিন লিখেছেন, ‘ভা ইরাসের মতো খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। কেন? আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনিরা, যারা অভিজিৎ-ওয়াশিকুর-অনন্তকে কুপিয়ে মেরেছে, তারা আমাকেও মেরে ফেলবে-এই ভয়ে। এতই যদি আমার ভয়, তা হলে ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও, কেন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করেছি? আর, কেনই বা বছরের পর বছর ভারতে শুধু থাকিইনি, থাকার জন্য যুদ্ধও করেছি? এ দুটো দেশেই তো জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এ দুটো দেশেই আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, আমার ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে, এ দুটো দেশেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। এত কাল পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত আমি ভয় পেয়ে পালাব? পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তো কোনো দিনই ছিলাম না। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই জেনেশুনে বাস করেছি।’
দ্য সেন্টার ফর ইনকোয়ারি (সিএফআই) নামক যুক্তরাষ্ট্রের একটি অলাভজনক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) তাঁকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নিয়ে যায়। এনজিওটি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ভারতীয় উপমহাদেশের মৌলবাদীদের অব্যাহত হত্যার হুমকির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে তসলিমাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দাবিও জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থাটি।
সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মুক্তচিন্তার কর্মী তসলিমা নাসরিন গত ২৭ মে নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন। তাঁকে সহায়তার জন্য একটি জরুরি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এ জন্য গত মঙ্গলবার সংস্থাটির দাতা ও অন্যান্য সাধারণ সদস্যের কাছে আবেদনও পাঠানো হয়েছে।
সংস্থাটি জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ব্লগার অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান ও অনন্ত বিজয়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে আরো বলা হয়, তসলিমা নাসরিন যদি কোনো কারণে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকতে না চান, তাহলে স্বল্প সময়ের জন্য তাঁর নিরাপত্তা দেবে সিএফআই।
ভারতে অবস্থানকালীন সময়ের কথা বর্ণনা করে তসলিমা লেখেন, ‘আমাকে গৃহবন্দী করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তারপরও ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে, একটি সেকিউলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ। তারপরেও ছিলাম দিল্লিতে। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারতবাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে, আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারতবাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুই মাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাকস্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীন ভাবে আমার মত প্রকাশ করব, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে পাথর ছোড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্য।’
মৌলবাদীদের হাতে বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হওয়ার দিনগুলোর কথা বর্ণনা করে তিনি লেখেন, ‘নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কিছু তো করিনি। অনেক বছর আগে, যখন আমার খুব নামডাক, ইসলামী মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে আমাকে জবাই করবে। খবরটি বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, তখন ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, ‘তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো।’ আমি সবাইকেই বলেছি, ‘আমাকে নয়, বাংলাদেশের গরিব মেয়েদের সাহায্য করো।’ আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিল, তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আমি বলেছি, ‘ও কাজটি কখনো কোরো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়েপরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাবে।”
সেকিউলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে বাংলাদেশের নিরীশ্বরবাদী লেখকদের বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরার প্রত্যয় ব্যক্ত করে তসলিমা নাসরিন লেখেন, ‘না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। এবার আমার আমেরিকায় আসার কিছু কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ, সেকিউলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে বলা, বাংলাদেশের নিরীশ্বরবাদী লেখকরা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছেন। এবং তাঁদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। আর হ্যাঁ, এখানে যে ফান্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মূলত খরচা হবে, দেশ থেকে ওই লেখকদের বিদেশে নিয়ে আসা এবং বিদেশে তাঁদের থাকা-খাওয়ার জন্য।’
লেখাটিতে তসলিমা নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের প্রচার, প্রচারণা ও হামলার কথা উল্লেখ করেন। ‘নব্বইয়ের শুরুতে লাখ লাখ মৌলবাদীর মিছিল দেখেছি, যে মিছিলে আমার ফাঁসির দাবি উঠত। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য ছেলেরা আজ দেশের প্রতিভাবান লেখকদের জবাই করে, নয়তো পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ বসায়। আমি তাদের পুরোনো শত্রু। ঢাকা থেকে দিল্লি তো খুব দূরে নয়। সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গেই বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করতে পারে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে চাপাতি চালানোর ট্রেনিংটাও হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনো শহরেই নিচ্ছে। ওদিকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হিট লিস্টে এখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল লেখক, যাঁরা ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিতে বিশ্বাসী, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী। লেখকরা আজ ভয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছেন, ঘরের কোণে লুকিয়ে রয়েছেন, দেশ ছাড়তে চাইছেন, মাথায় হেলমেট পরে বাইরে বেরোচ্ছেন, কেউ কেউ শহর ছেড়ে চলে গেছেন অচেনা গ্রামে, চেহারা বদলে মিশে গেছেন মানুষের ভিড়ে।’
বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, যুক্তিতে বিশ্বাসী লেখকদের বর্তমান অবস্থানের কথাও লেখেন তিনি, “সবাই ভাবছে, কোপ এবার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতি মাসেই একজনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু লেখক, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, ‘বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও।’ খুনিদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ‘ওপরের নির্দেশ নেই।’ শুধু লেখক বা ব্লগারদের নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। তাঁর দোষ, তিনি তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়।”
জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন তিনি তাঁর লেখায়। ‘অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান আর অনন্ত বিজয় দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা একটি বিবৃতিও দেননি। খুনিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কোনো ব্যবস্থা নেবে না, মৃত্যুর হুমকি পাওয়া মুক্তমনা লেখকদেরও নিরাপত্তা দেবে না, এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া ওঁদের আর কোনো উপায় নেই। আপাতত বাঁচুন, দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিরবেন দেশে। মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবীর চান না, ব্লগাররা দেশ ছাড়ুক। তিনি বলছেন, দেশ ছেড়ে কোনো লাভ হবে না, লাভ হবে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে। জামাতে ইসলামী নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা মুক্তমনা লেখকদের খুন করবে না, এ কথা হলফ করে কে বলতে পারে?’
জামায়াত ইসলামীর চেয়েও বেশি ভয়ংকর মৌলবাদী সন্ত্রাসীর আবির্ভাব হয়েছে দেশে দাবি করে তিনি লেখেন, ‘গত দুই দশকে অজস্র মৌলবাদী সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, যারা জামায়াতে ইসলামীর চেয়েও বেশি ভয়ংকর। তারা আইসিস (আইএস), আল-কায়েদার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবীর বললেন, তাঁর হাতে পিস্তল আছে এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। উনি না হয় লাইসেন্সসহ পিস্তল জোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্পবয়সী লেখকরা পিস্তল কোত্থেকে জোগাড় করবেন, লাইসেন্সই বা তাঁদের কে দেবে? যে সরকার তাঁদের কোনো দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার তো লাইসেন্স দেবে না। কিছুদিন আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। যে দল খুন করে এসে গোটা দেশকে জানিয়ে দিচ্ছে তারা খুন করেছে, তারপরও তাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে না সরকার, তাদের নিষিদ্ধ করলেই কি, না করলেই কি!’
সমাজকে বদলের জন্য মানুষকে বাঁচানো জরুরি উল্লেখ করেছেন তিনি লেখায়। তসলিমা নাসরিন লেখেন, ‘সমাজ যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেই চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে, ধর্মান্ধদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি। অন্য কোনো অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস, বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যাঁরা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তাঁরা অনেকেই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন : ‘ব্লগাররা কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেননি।’ তা হলে কি ধর্মান্ধদের মতোই, তাঁরাও মনে করেন- ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।”
তসলিমা নাসরিন আরো লেখেন, ‘অনুভূতিতে কোনো রকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবিই বরং অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মতামত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি একবার কেন, বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে, অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে, যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।’
ধর্মানুভূতির রাজনীতি বনাম গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার রক্ষার কথা উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেক কাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনো একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই, না কি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার রক্ষা করতে চাই?’
ধর্মব্যবসা বন্ধ না করে, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে না উল্লেখ করে তসলিমা নাসরিন লেখেন, ‘পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্রবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্মব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’
বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত চিরকালের উল্লেখ করে তিনি লেখেন, “নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে, ‘ওঁরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেননি’— এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত : ওঁরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের সংঘাত চিরকালের। কিন্তু বিজ্ঞান যে মানে না, তাকে বিজ্ঞানীরা ধারালো ছুরি নিয়ে কোপাতে যান না। কিন্তু ধর্ম যে মানে না, ধার্মিকরা তাদের কোপাতে যায়। একবিংশ শতাব্দীতে ১৪০০ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।”
ভারতে ফেলে আসা নৈমিত্তিক জীবনের স্মৃতিচারণা করে লেখিকা লেখেন, “সেকিউলার সংগঠনটি তাদের ফান্ড রেজিংয়ের (অনুদান গ্রহণ) চিঠিটি বিলি করার পরই সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের সব প্রচারমাধ্যমের কাছে, ‘আমি আমেরিকায় এসেছির চেয়ে বড় খবর ‘আমি ভারত ছেড়েছি’। আমার ভারত ছাড়ার খবরটা যারাই ছড়িয়েছে, একটু বাড়াবাড়ি করেই ছড়িয়েছে। চিঠিতে লেখা ছিল না : আমি তল্পিতল্পা নিয়ে জন্মের মতো ভারত ছাড়ছি। ভারত ছেড়ে কোথায় যাব? এখনো তো ভারতেই পড়ে আছে আমার বাড়িভর্তি বইখাতা, কাপড়চোপড়, অযুত-নিযুত জিনিসপত্তর, পোষা বেড়াল।”
নয়াদিল্লি থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানের বেরোনোর খবর উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ‘দিল্লি থেকে বেরিয়েছি ছোট একটা সুটকেসে দুটো জিন্স, দুটো শর্টস, আর কটা টি-শার্ট নিয়ে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড তো হাতে থাকেই, সে যেখানেই যাই। ভারত ছাড়ার খবরটা নিঃসন্দেহে কোনো সুখবর নয়। আমার কোনো সুখবর কি কখনো কোথাও প্রকাশ হয়েছে! এই যে দীর্ঘ ২২ বছর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার সংগঠন, নারীবাদী দল আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, একটা সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে নিজের সময়, শ্রম, অর্থকড়ি, বিদ্যেবুদ্ধি সব ঢেলে দিচ্ছি, এই যে এত সভ্য দেশ থেকে এত সম্মান পেয়েছি, এত পুরস্কার, এত ডক্টরেট-উপমহাদেশের কোথাও কেউ কি খবর করেছে? কখনো করেনি, শুধু লিখে গেছে কটা পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি, কটা বিয়ে করেছি, কোন দেশ আমাকে তাড়িয়েছে, কোন রাজ্য আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়েছে, কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, কত লোক আমার লেখা পছন্দ করে না, আমাকে লক্ষ্য করে লোহার চেয়ার ছুড়ে মারা হয়, রাজ্য আমার বই নিষিদ্ধ করে, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল দেখাতে আপত্তি করে-এসব।’
তসলিমা নাসরিন তাঁর নামের আগে জুড়ে দেওয়া ‘বিতর্কিত’ শব্দটির সমালোচনা করে লেখেন, ‘আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ, ‘বিতর্কিত’। শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। ‘বিতর্কিত’ বিশেষণটি আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, সব রকম চেষ্টা করেছে, যেন আমি হয়ে উঠি একটা নিষিদ্ধ নাম, একজন নিষিদ্ধ লেখক।’
‘দেশের মানুষের ভালো চাইলে কষ্ট পেতে হয়’ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখায়। ‘এত কাল কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি, আমি কোথায় আছি, বা আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছাড়লাম কেন জানতে চাইছে। ভারতের মৌলবাদী-তোষক রাজনীতি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, গরিবের অসহায়তা, সামাজিক অব্যবস্থা, ধর্ম, জাতপাত, পুরুষতন্ত্র, কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে কট্টর জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিক নারীবিরোধীরা আমাকে নোংরা নোংরা গালি দিয়েছে, আমাকে ভারত ছাড়তে বলেছে, বলেছে বাংলাদেশে ফেরত যেতে। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালেঅ চাইলে, অনেক কষ্ট পেতে হয়।’
তসলিমা নাসরিন আরো লেখেন, ‘রিফিউজি, বেগার, ইউ বাংলাদেশি, আমাদের দেশের কোনো ব্যাপারে নাক গলাবি না-এ সব ধমক অনেক শুনেছি। অনেকের ধারণা, আমার নিশ্চয়ই কোনো বদ-মতলব আছে, তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিত হলে আমি এত রাগ করি কেন, কন্যাশিশুদের পুঁতে ফেলা হলে আমি এত রুখে উঠি কেন, নারী নির্যাতন বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ দেশ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাত্থি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে-প্রায়ই শুনি এমন হুমকি।’
‘একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আর একদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, কুসংস্কারের ডিপো, উগ্র হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকিউলার দলের- তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সরল সমীকরণ : আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু, নিশ্চয়ই খ্রিস্টান অথবা ইহুদি মৌলবাদীদের বন্ধু। ভারতের উদারপন্থী সেকিউলারদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড।’
বিশ্বের যেখানে নারীদের ওপর সহিংসতা হয়, সেখানেই প্রতিবাদ করবেন বলেও উল্লেখ করেন তসলিমা নাসরিন। ‘শুধু ভারতবর্ষে বধূ হত্যা হলেই নয়, সোমালিয়ার মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদন হলেও, ইতালির মেয়েদের গর্ভপাতে বাধা দেওয়া হলেও, সৌদি আরবে মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করা হলেও আমি প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলেই নয়, গুজরাটে বা ফিলিস্তিনে মুসলমানরা, পাকিস্তানে খ্রিস্টানরা অত্যাচারিত হলেও প্রতিবাদ করি। এ কথা সেকিউলার লোকদের অজানা নয়। তাদের অজানা নয় যে, যুগ যুগ ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভাসমান জীবন কাটিয়েও, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে, গৃহবন্দিত্ব সয়ে, ঘাড় ধাক্কা, অন্যায়, অপমান, অপবাদ, নিষেধাজ্ঞা, ঘৃণা সয়েও, আমি মানবাধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, বাকস্বাধীনতার জন্য, সহিষ্ণুতার জন্য, সমতার জন্য লড়াই করছি। তারপরও আমাকে ব্রাত্য করতে এরা দ্বিধা করেনি।’
এত না পাওয়ার ভিড়েও ‘মানুষের ভালোবাসার’ কথা উল্লেখ করেছেন এই লেখিকা, ‘এদের বাইরেও মানুষ আছে, যারা আমাকে ভালোবাসে। ভারতবর্ষের কত কত শহরে কত কত মানুষ দৌড়ে আসে সই নিতে, ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি একদিন ফিরে যাবই। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে অসংখ্য চেনা-অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী। ওই ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।’