মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল
মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা,বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
urgentPhoto
আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি যাবে ট্রাইব্যুনালে। এর পর ট্রাইব্যুনাল মুজাহিদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। সেটা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি দেওয়া হবে মুজাহিদকে। এর পর রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন আলবদরপ্রধান মুজাহিদ।
রায়ে বলা হয়,৬ নম্বর অভিযোগ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী হত্যা-গণহত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ১ নম্বর অভিযোগ সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেন হত্যার দায় থেকে মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন আদালত, এ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া ৭ নম্বর অভিযোগে ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দুদের গণহত্যার দায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল, এর পরিবর্তে যাবজ্জীবর কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। ৫ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ, ৩ নম্বর অভিযোগে তাঁর পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশও বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সাতটি অভিযোগ আনা হয়। তার মধ্যে পাঁচটি আভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ডাদেশসহ বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত করেন ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া দুটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
আজ আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান এবং অ্যাডভোকেট শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া ২৫ পৃষ্ঠার লিখিত যুক্তিও আদালতে দাখিল করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।
রায় শেষে মাহবুবে আলম বলেন, ‘আজকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ব্যাপারে যে রায় আমরা পেলাম, অন্তত সারা দেশের বুদ্ধিজীবীরা, এ দেশে যাঁরা সংস্কৃতি চর্চা করেন, যাঁরা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সমন্বিত রাখার স্বপ্ন দেখেন, তারা সবাই খুশি হবেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে রাষ্ট্র তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। এরই মধ্যে তারা যদি কোনো রিভিউ ফাইল করে আপনাআপনি এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতেই হবে।’
এদিকে, মুজাহিদের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, এই রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করবেন তাঁরা।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপিল ডিভিশন যে জাজমেন্ট (রায়) দিয়েছেন তাঁদের বিবেচনায় তাঁরা দিয়েছেন এবং আমরা আমাদের রায়ের কপি পেয়ে রিভিউ করব। যে রায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে সেখানে পর্যাপ্ত সাক্ষী-প্রমাণ নাই বলে আমরা মনে করি। অতএব অবশ্যই রিভিউতে ফাঁসির আদেশ বহাল থাকবে না।’
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠন আলবদরের প্রধান ছিলেন মুজাহিদ। বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় সমাজকল্যাণমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মুজাহিদের আপিল শুনানিতে গত ২৯ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ছয় কার্যদিবসে ট্রাইব্যুনালের রায় ও মামলা-সংক্রান্ত নথিপত্র (পেপারবুক) পাঠ শেষ করে আসামিপক্ষ। এর পর গত ২৫, ২৬ ও ২৭ মে মোট তিন কার্যদিবস আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষে মামলায় যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়।
গত ২৭ মে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি শেষ হয়। ওই দিন রায়ের জন্য ১৬ জুন চূড়ান্ত রায় দেওয়া হবে বলে দিন ধার্য করা হয়।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদ। এ ঘটনায় ২০১১ সালের ২১ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন কর্মকর্তারা।
এর পর ২ আগস্ট তাঁকে অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে ২০১২ সালের ২১ জুন মুজাহিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট সাতটি অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ১১ আগস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।
মুজাহিদের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
অভিযোগ-১ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকার চামেলীবাগ থেকে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণ করা হয়। মুজাহিদের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণাধীন সাত-আট যুবক তাঁকে ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ-২ : প্রসিকিউশনের দ্বিতীয় অভিযোগে বলা, ১৯৭১ সালের মে মাসে একদিন আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার চরভদ্রাসন থানার বিভিন্ন গ্রামের ৩০০-৩৫০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা। পরে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ৫০-৬০ জন হিন্দু নর-নারীকে হত্যা করা হয়।
অভিযোগ-৩ : তৃতীয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন ফরিদপুর শহরের খাবাসপুর মসজিদের সামনে থেকে রাজাকাররা ফরিদপুর জেলার কোতোয়ালি থানার গোয়ালচামট এলাকার রণজিৎ নাথ ওরফে বাবু নাথকে আটক করে। ফরিদপুর পুরোনো সার্কিট হাউসে আসামি আলী আহসান মুজাহিদের সামনে পাকিস্তানি সেনা অফিসার মেজর আকরাম কোরাইশীর কাছে হাজির করা হয় বাবু নাথকে। তখন মুজাহিদ ওই মেজরের সঙ্গে কথা বলার পর বাবু নাথের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তাঁর একটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়। নির্যাতনের পর মুজাহিদের ইশারায় তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশে বিহারি ক্যাম্পের উত্তর পাশে আবদুর রশিদের বাড়িতে নিয়ে রাজাকাররা আটকে রাখে। পরের রাতে রণজিৎ নাথ বাবু তাঁর আটক ঘরের জানালার শিক বাঁকা করে ওই ঘর থেকে পালিয়ে জীবন বাঁচান।
অভিযোগ-৪ : চতুর্থ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৬ জুলাই সকালে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থেকে স্থানীয় রাজাকাররা মো. আবু ইউসুফ ওরফে পাখিকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে আটক করে। এর পর তাঁকে ফরিদপুর স্টেডিয়ামে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে রাখা হয়। আটক বন্দিদের মধ্যে আবু ইউসুফ পাখিকে দেখে মুজাহিদ পাকিস্তানি মেজরকে কিছু একটা বলার পরই তাঁর ওপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। সেখানে এক মাস তিন দিন আটক রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ নির্যাতনে আবু ইউসুফ পাখির বুকের ও পিঠের হাড় ভেঙে যায়।
অভিযোগ-৫ : পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট রাত ৮টায় পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের আরেক নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ ঢাকার নাখালপাড়ার পুরনো এমপি হোস্টেলের আর্মি ক্যাম্পে যান মুজাহিদ। সেখানে তাঁরা আটক সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহির উদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে দেখে তাঁদের গালাগাল করেন এবং পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে বলেন, প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাঁদের হত্যা করতে হবে। আসামি মুজাহিদ অন্যদের সহায়তায় আটকদের একজনকে ছাড়া অন্য নিরীহ-নিরস্ত্র বন্দিদের অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে লাশ গুমের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
অভিযোগ-৬ : প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আনা এ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২৭ মার্চের পর ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প করে। পরে রাজাকার, আলবদর বাহিনীও সেখানে ক্যাম্প করে। মুজাহিদ ছাত্রসংঘের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্রসংঘের ও আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র নেতা হিসেবে আর্মি ক্যাম্পে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন।
এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুজাহিদ ১০ ডিসেম্বর থেকে পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধনসহ হত্যা, নির্যাতন, বিতাড়নের মতো যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটিত করেন।
অভিযোগ-৭ : প্রসিকিউশনের আনা সর্বশেষ অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ১৩ মে আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দুদের ওপর গণহত্যা চালায়।