এক যুগপূর্তি
এনটিভি বাংলাদেশের জনগণের টিভি : আলহাজ্ব মোসাদ্দেক আলী
২০০৩ থেকে ২০১৫। মাঝখানে একযুগ। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে মানের ক্ষেত্রে আপসহীন এনটিভি আজ এ দেশের সবচেয়ে আস্থাভাজন গণমাধ্যম হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় অনেক পরিবর্তন, চড়াই-উৎরাই আর মোড় পেরিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সূচনালগ্ন থেকে আজকের দিনের এই সাফল্যের ইতিবৃত্ত অকপট আলাপে জানিয়েছেন এনটিভির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী।
প্রশ্ন : কী স্বপ্ন নিয়ে এনটিভির যাত্রা শুরু হয়েছিল?
উত্তর : এনটিভির যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালের ৩ জুলাই। ওই সময়ে বা তার আগে আমি যখনই দেশের বাইরে গিয়েছি, প্রবাসী বাংলাদেশিরা সব সময় দেশের খবর জানতে চাইতেন। তখন বাংলাদেশের প্রাইভেট টিভি চ্যানেল ছিল মাত্র তিনটি। আমি তখন চিন্তা করলাম, গণমাধ্যমের কাজ তো মানুষকে জানানো। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটা গণমাধ্যমের মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায়। আর দেশ এবং দেশের বাইরে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য তখন ইলেকট্রনিক মাধ্যমটাই ছিল সবচেয়ে কার্যকর। আর বাংলাদেশ সম্পর্কে বাইরে অনেকের ধারণা নেতিবাচক। কিন্তু বাংলাদেশেরও তো অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। আর সেগুলো তুলে ধরার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। সে চিন্তা থেকেই এনটিভির যাত্রা শুরু। আমরা শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক মানের একটি টেলিভিশন চ্যানেল করতে চেয়েছি। সে জন্য প্রথম দিন থেকেই আমাদের যুক্তরাষ্ট্র অফিসের কাজ শুরু হয়। এরপর অস্ট্রেলিয়া ও দুবাইতে অফিস চালু করি। এখন ইউরোপসহ বিশ্বের সব অঞ্চলেই আমাদের অফিস রয়েছে। সারা বিশ্বেই আমরা ছড়িয়ে পড়েছি।
প্রশ্ন : দেখতে দেখতে এনটিভি একযুগ পার করে ফেলেছে। এই ১২ বছরে দেশে-বিদেশে দর্শকের সবচেয়ে আস্থার চ্যানেলে পরিণত হয়েছে এনটিভি। বিনোদন এবং সংবাদের মিশ্র চ্যানেলগুলোর মধ্যে এনটিভি এখনো শীর্ষে। এই যে আস্থা অর্জন, এর পেছনে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন আপনি?
উত্তর : প্রথমেই আল্লাহতায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করি। আমরা প্রথম দিন থেকেই টেলিভিশনের মানের সঙ্গে কোনো আপস করিনি। ২০০৩ সালে যখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রে যাত্রা শুরু করি, সেখানে দুজন মার্কিন সিনেটর আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ছিলেন। তাঁরা আমাদের চ্যানেল দেখে বলেছিলেন যে, সিএনএনের চেয়েও আমাদের চ্যানেলের স্ক্রিন অনেক বেশি ঝকঝকে। এই প্রশংসা কিন্তু অনেক বড় বিষয়। আমরাও শুরু থেকেই মানটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি সব সময়। শুধু অনুষ্ঠান বা খবরে নয়, বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও কিন্তু আমরা মান দেখি। বিজ্ঞাপনের ছবি বা শব্দের মান যদি ভালো না হয়, আমরা সেসব বিজ্ঞাপন নেই না। আমরা যখনই যেটা করেছি, সেটা সেরা করার চেষ্টা করেছি। যেমন রিয়েলিটি শো ক্লোজআপ ওয়ানের কথা বলি। বাংলাদেশে এখন এত রিয়েলিটি শো হয়, কিন্তু ক্লোজআপ ওয়ানকে কিন্তু ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কোনোটিই। আর আমরা কিন্তু শুধু দেশের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। গতবারের ক্লোজআপ ওয়ানে যে রানার আপ হয়েছিল, সে কিন্তু দুবাইপ্রবাসী বাংলাদেশি। অর্থাৎ সারা বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিরা রয়েছেন, সেখানেই আমরা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। যেখানেই বাংলাদেশিরা আছেন, সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে আসতে চেয়েছি। এখন যেমন চলছে ‘কুরআনের আলো’ রিয়েলিটি শো। এসব অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য কিন্তু অর্থ উপার্জন নয়, বরং দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেধাবীদের তুলে আনা, তাদের গড়ে তোলা। ‘কুরআনের আলো’ রিয়েলিটি শোতে যারা গত বছর সেরা হয়েছিল, তারা এখন দেশের বাইরে লন্ডন, কাতার, দুবাইয়ে তারাবির নামাজ পড়াচ্ছেন; অর্থাৎ তারা সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছেন নিজেদের মেধার জোরে।
রিয়েলিটি শোগুলো কিন্তু বড় বাজেটের করা হয়, যাতে মানে কোনো ঘাটতি না থাকে। সেই সঙ্গে আমরা নির্মাণে অনেক পরিশ্রম করি এবং সময় দেই। এ জন্যই হয়তো মানুষ এত ভালোবাসে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যখন শিল্পী সংকট ছিল, তখন আমরা চালু করেছিলাম ‘সুপার হিরো সুপার হিরোইন প্রতিযোগিতা’। এ প্রতিযোগিতা থেকে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা কিন্তু এখন বাংলাদেশের সিনেমাজগতে প্রতিষ্ঠিত। আবার যারা ভালো গান গায়, কিন্তু সুযোগ হয়ে ওঠে না গান শোনানোর- তাদের নিয়ে আমরা একটা অনুষ্ঠান করেছি ‘আমারও গাইতে ইচ্ছে হলো’। এখানে নতুন শিল্পীরা নিজের গান নিজেই গাইতে পারেন। এনটিভি-ই প্রথম দর্শকদের গল্প নিয়ে নাটক তৈরি করেছিল। এটা তখন কারো ভাবনাতেই ছিল না যে দর্শকদের লেখা গল্পে টেলিভিশনে নাটক প্রচারিত হবে। এখন অনেক চ্যানেলের গানের অনুষ্ঠানে দেখা যায় এনটিভির ক্লোজআপ ওয়ানের শিল্পীরাই গান গাচ্ছেন। আমরা নিজেরাও অডিশনের মাধ্যমে শিল্পী বাছাই করেছি এবং তাঁদেরকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছি। অনুষ্ঠান উপস্থাপকদেরও একই প্রক্রিয়ায় বাছাই করে আনা হয়েছে এবং তাঁরাই কিন্তু এনটিভিতে নিয়মিত অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। নতুনদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন : দর্শকের আস্থার সঙ্গে সঙ্গে গত ১২ বছরে এনটিভির সবচেয়ে বড় অর্জন কী বলে মনে করেন?
উত্তর : আমরাই দেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেল যারা আইএসও সনদ পেয়েছি। এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যায়। কারণ এটা তো মানের দিক থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিকভাবেই আমাদের মান স্বীকৃতি পেয়েছে।
প্রশ্ন : কোনো ব্যর্থতা আছে কি?
উত্তর : কয়েক বছর আগে আমি ঘোষণা দিয়েছিলাম ‘এনটিভি প্লাস’ নামের একটি বিনোদনমূলক টেলিভিশন চ্যানেল করব। লাইসেন্সের জটিলতার কারণে সে কাজটি এখনো ঠিকভাবে করা হয়ে ওঠেনি। আমি নিজে স্পোর্টসের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত। ২৩ বছর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। খেলাধুলার মানুষজনরাও বলে একটি খেলার চ্যানেল করার জন্য। এনটিভি স্পোর্টস নামে খেলাধুলার জন্য একটি আলাদা চ্যানেলও করতে চাই। সেই সঙ্গে নিজেদের ভবনে যাওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। দুবার আগুন লেগে আমাদের অফিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে। সেটা কাটিয়ে উঠতে চাই। নিজেদের ভবনে গিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন : আপনি সব সময় বলে থাকেন, এনটিভি কর্মীদেরই প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে আপনার চাওয়া বা পরামর্শ কী?
উত্তর : আমাদের চ্যানেলে কিন্তু কোনো কর্মী নেই। সবাই চ্যানেলের মালিক। এটা শুধু বলার জন্য বলা না, সবাই সেটা কাজে প্রমাণ করেছেন। আমরা একটি পরিবারের সদস্যের মতোই কাজ করি। যখন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আমাদের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন সবাই নিজেদের বাসা থেকে ল্যাপটপ এনে অফিসে বসে কাজ করেছে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা আবার সম্প্রচারে ফিরেছিলাম। এই যে প্রতিষ্ঠানকে নিজের পরিবারের মতো করে মনে করা, এটা অনেক বড় বিষয়। অনেক বড় আন্তরিকতা। এই আন্তরিকতার কারণেই এনটিভি আর সবার থেকে আলাদা।
প্রশ্ন : একযুগ তো পার হলো। আরো একযুগ পর অর্থাৎ আরো ১২ বছর পর এনটিভিকে কোথায় দেখতে চান? কেমন দেখতে চান?
উত্তর : এনটিভি বাংলাদেশের জনগণের টিভি। এটা দেশের মানুষের সম্পদ। আগামী ১২ বছর কেন, আরো যুগ যুগ ধরে এনটিভি বাংলাদেশের মানুষের কথা বলে যাবে-সেটাই প্রত্যাশা করি। সকল রাজনীতির ঊর্ধ্বে দেশের মানুষের কথা বলবে এনটিভি, বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে। এনটিভির মূল শক্তি এর দর্শক। তাঁরা কিন্তু প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে ফিডব্যাক পাঠান। সেগুলো সংগ্রহ করা হয় এবং আমি নিজে সেগুলো যতটা পারি পড়ে দেখি। দর্শকদের সঙ্গে এই যোগাযোগটা আমাদের সব সময় থাকবে আর এভাবেই আমরা আরো এগিয়ে যাব বলে আশা রাখি।
প্রশ্ন : আপনার তো একটি রাজনৈতিক পরিচয়ও রয়েছে। এই রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতার প্রভাব কি কখনো এনটিভির ওপর পড়েছে?
উত্তর : দেখুন রাজনীতির বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিটি মানুষেরই রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে, অধিকার রয়েছে। আমরা তো সবাই ভোট দেই। আমার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেকের মনে একটা ধারণা থাকতে পারে যে এনটিভির কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। তবে এই ধারণা একেবারেই ভুল, অমূলক। এনটিভি একদম নিরপেক্ষ গণমাধ্যম। এনটিভির যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে, তখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু এনটিভির লাইসেন্স নেওয়া হয়েছিল আরো আগে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে; ইন্টারন্যাশনাল টেলিভিশন চ্যানেল লিমিটেড নামে। এনটিভির কোনো অনুষ্ঠান বা খবরে বলুন, কখনোই দেখবেন না রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা প্রভাব রয়েছে। এটি গণমানুষের গণমাধ্যম।
প্রশ্ন : এখন তো অনেক নতুন চ্যানেল আসছে। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
উত্তর : অনুষ্ঠান এবং সংবাদের মান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করাটাই সাফল্যের চাবিকাঠি। মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন এমন ছিল যে কিছু শিল্পী বিটিভিতে কাজের সুযোগ পেতেন না, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছিল। আমরা কিন্তু তাঁদের নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। শিল্পীরা হলেন শিল্পী, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে বঞ্চিত করা ঠিক না। আমরা সব নাটক প্রচারের আগে প্রিভিউ করি। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিচিতি বা জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয় না। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের দেশের অত্যন্ত মেধাবী এবং জনপ্রিয় একজন লেখক, পরিচালক। তিনি যখন চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছিলেন শেষবারের মতো, তখন এই বিষয়ে একটি কথা বলেছিলেন। সব টিভি চ্যানেল তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নাটক নেয়, আমরাও তাই করতাম। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, এনটিভি একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল যেটি তাঁর নাটক প্রিভিউ হওয়ার পর আবার সংশোধন করিয়ে নিয়েছে। আমরা এভাবেই মানের ক্ষেত্রে কখনই ছাড় দেইনি। মান বজায় রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন : এনটিভির একযুগ পূর্তির কিছু আগেই শুরু হয়েছে এনটিভি অনলাইন, ntvbd.com। এনটিভি অনলাইন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী?
উত্তর : এখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই সব খবর পাওয়া যায় অনলাইনে, ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। সেই চিন্তা থেকেই আমরা অনলাইন চালু করেছি। আমি দেখেছি বাংলাদেশে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের ওপর অনলাইন রয়েছে যেমন শেয়ারবাজার, বিনোদন ইত্যাদি। পূর্ণাঙ্গ নামের যে অনলাইনগুলো রয়েছে, তাতে কিন্তু সবকিছু নেই। এটা আছে তো, ওটা নেই। এনটিভি অনলাইনই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইট যাদের ছবি, ভিডিও, খবর, আলাদা অনুষ্ঠান-সবই রয়েছে। এনটিভির ১২ বছরে যে পরিমাণ অনুষ্ঠান এবং খবরের ভিডিও রয়েছে সেটা কিন্তু আর কারো নেই, এটা আমাদের অনন্য শক্তি। আমি বিশ্বাস করি, এনটিভি অনলাইন ভালো করবে, স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে একটি ভালো অবস্থানে আসবে এবং এ দেশের সেরা অনলাইন পোর্টালে পরিণত হবে। এ জন্য একটু সময় লাগবে, তবে সাফল্য আসবেই। আমি সব সময়ই আশাবাদী মানুষ।
প্রশ্ন: দর্শক-শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
উত্তর : দর্শকরাই আমাদের মূল বিচারক। তাঁদের চাহিদা পূরণে আমরা সচেষ্ট থাকব। আমাদের এত দিনের অগ্রযাত্রায় আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ। দর্শক, শুভানুধ্যায়ী, ক্যাবল অপারেটর, বিজ্ঞাপনদাতা- সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ, সবাইকে আমাদের পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।