নারীর মর্যাদা রক্ষায় তেজোদীপ্ত ভূমিকা নুসরাতকে অমরত্ব দিয়েছে
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার দায়ে মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত নারীর মর্যাদা রক্ষায় তাঁর ‘তেজোদীপ্ত ভূমিকার’ প্রশংসা করে বলেছেন, এ ঘটনা তাঁকে অমরত্ব দান করেছে এবং এই অমরত্ব চিরকালীন অনুপ্রেরণা।
আজ বৃহস্পতিবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ বেলা সোয়া ১১টার দিকে সব আসামির উপস্থিতিতে এ রায় দেন। রায়ে প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ খুনির সবার ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। এর আগে বেলা ১১টা ৭ মিনিটে জনাকীর্ণ আদালতের এজলাসে এসে হাজির হন বিচারক। তিনি সংক্ষিপ্ত রায় পড়েন।
ফাঁসির আদেশ পাওয়া মামলার আসামিরা হলেন—প্রধান আসামি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলা, দুই নম্বর আসামি ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের আহ্বায়ক মো. নুর উদ্দিন, তিন নম্বর আসামি মাদ্রাসার ফাজিলের ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, চার নম্বর আসামি পৌর আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক এবং ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, পাঁচ নম্বর আসামি ছাত্রলীগকর্মী ও মাদ্রাসার ফাজিল বিভাগের ছাত্র মো. জোবায়ের, ছয় নম্বর আসামি চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী জাবেদ হোসেন, সাত নম্বর মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষক এবং ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হাফেজ আবদুল কাদের, আট নম্বর আসামি মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আফছার উদ্দিন।
ক্রমানুসারে অন্য আসামিরা হলেন মাদ্রাসার ফাজিল প্রথম বর্ষ ও ফেনী পলিটেকনিক কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আবদুর রহিম ওরফে শরীফ, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রলীগকর্মী মো. শামীম, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলন সদস্য ও ফেনী কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এমরান হোসেন মামুন, মাদ্রাসা শাখা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ইফতেখার উদ্দিন রানা, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা মুক্তি পরিষদ আন্দোলনের সদস্য ও ছাত্রদলকর্মী হিসেবে পরিচিত মহিউদ্দিন শাকিল, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি, মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী কামরুন নাহার মণি।
রায়ের আগে আদালতের অনুমতি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ফেনী জেলা কারাগার থেকে মামলার ১৬ আসামির সবাইকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। পিনপতন নীরবতার মধ্যে বিচারক রায়ের কাজ শুরু করেন।
চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। মাদ্রাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় কালিমালিপ্তকারী এ ঘটনা বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীর মর্যাদা রক্ষায় ভুক্তভোগী নুসরাত জাহান রাফির তেজোদীপ্ত আত্মত্যাগ তাঁকে এরই মধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তাঁর এ অমরত্ব চিরকালের অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয়। বিধায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য।’
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয়কে রাষ্ট্রপক্ষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক আসামিবৃন্দকে, পূর্বপরিকল্পিতভাবে অত্র মামলার ভুক্তভোগী নুসরাত জাহান রাফিকে গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টা ৪৫ থেকে ৫০ মিনিটের মধ্যে মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টার ভবনের তৃতীয় তলার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের ওড়না দিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাঁকে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত ২০০০ (সংশোধিত/০৩)-এর ৪(১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সবাইকে দণ্ডিত করা যায়।’
রায়ের আগে আজ সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ফেনী জেলা কারাগার থেকে মামলার ১৬ আসামির সবাইকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। মামলার রায় শুনতে আদালতে নুসরাতের পরিবারের সদস্য ছাড়াও মামলার আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও আসামিদের স্বজনরাও হাজির ছিলেন। আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তার মধ্যেও উৎসুক মানুষের ভিড় লক্ষ করা গেছে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একটি প্রিজনভ্যানে করে আসামিদের কারাগার থেকে বের করা হয়। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে তাদের আদালত চত্বরে নিয়ে আসা হয়। এ সময় প্রিজনভ্যানটিকে মাঝখানে রেখে দুইপাশে ছিল পুলিশের গাড়ি। তারপর হাতকড়া পরা অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে আসামিদের প্রিজনভ্যান থেকে নামিয়ে আদালতের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়া হয়। কাঠগড়ায় আসামিদের উদ্বিগ্ন দেখা যাচ্ছিল। কামরুন নাহার মনি তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে নিয়েই কাঠগড়ায় উপস্থিত হন। রায় পড়ার সময় আসামিরা দোয়া পড়ছিলেন। রায় শোনার পর পরই আসামিরা কাঠগড়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন।
চাঞ্চল্যকর এই রায়কে ঘিরে ফেনী শহর ও আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তা নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নুসরাতের বাড়ি ঘিরেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা।
এ মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি শেষ হয় গত ৩০ সেপ্টেম্বর। তারপরই আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেন। মামলার বিচারকাজ শুরুর ৬২ দিনের মধ্যে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। দ্রুততম সময়ে এই মামলার বিচারকাজ শেষ করা একটি দৃষ্টান্ত বলে উল্লেখ করেছেন আদালত-সংশ্লিষ্টরা।
মামলায় সোনাগাজী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। আসামিদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা কমিটির সভাপতি, প্রভাবশালী কাউন্সিলর, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের কর্মী থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীরাও রয়েছেন।
নুসরাত হত্যার নেপথ্যে
মামলার বিবরণে জানা যায়, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে ২৭ মার্চ সোনাগাজী থানায় অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ মামলায় গত ২৭ মার্চ পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।
সিরাজ-উদ-দৌলার নির্দেশে মাকসুদ কমিশনার ও শাহাদাত হোসেন শামীম তাঁদের অনুসারীদের নিয়ে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সোনাগাজী বাজারে মানববন্ধন করে এবং থানা ঘেরাও করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে সিরাজ-উদ-দৌলার অনুসারীরা নুসরাতকে মামলাটি উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু নুসরাত মামলা উঠিয়ে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরে গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিমের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঁচ দিন পর ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়।
পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে জানাজা শেষে নুসরাতকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বাদী হয়ে ৮ এপ্রিল নুসরাতকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। পরে সেটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
নুসরাতের ওপর হামলার ঘটনায় ফেনী, সোনাগাজীসহ সারা দেশের মানুষ ফুঁসে ওঠে। মশাল মিছিল, মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল করে দোষীদের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবি করে।
তবে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী, থানা পুলিশ, কয়েকজন সুবিধাভোগী সাংবাদিক মরিয়া হয়ে অপপ্রচার চালাতে থাকে। সে সময়ের জেলা পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের পক্ষে সাফাই গেয়ে নুসরাত আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দেয়।
এ প্রতিবেদনের কারণে পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে ফেনী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকা পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। একই সময়ে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়। এর আগে গত ২৭ মে নুসরাতের শ্লীলতাহানির ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতকে থানায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেনস্তা করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিও প্রচারের এ ঘটনায় আইসিটি আইনে মামলায় ওসি মোয়াজ্জেম বর্তমানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন।
পরে এ মামলা তদন্ত করার জন্য পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে গত ২৯ মে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেন নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মো. শাহ আলম।
এ মামলায় আটক থাকা অভিযোগপত্রের বাইরের পাঁচজনকে বিচারিক আদালত মামলার দায় থেকে অব্যহতি দেন। তাঁরা হলেন কেফায়েত উল্লা, আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, সাইদুল ইসলাম ও আলাউদ্দিন।
অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ৩০ মে মামলাটি ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ১০ জুন আদালত মামলাটি আমলে নিলে শুনানি শুরু হয়। ২০ জুন অভিযুক্ত ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বিচারিক আদালত। এর পর ২৭ ও ৩০ জুন মামলার বাদী ও নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানকে জেরার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারকাজ শুরু হয়। এর পর মোট ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেন আদালত।