দিনে কাজ, রাতে পড়াশোনা করত রাকিব
খুলনা শহরের টুটপাড়ার সেন্ট্রাল রোড। এখানেই মা, বাবা ও ছোটবোনের সঙ্গে বাস করত চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাকিব। গাড়ি চালক বাবার টাকায় সংসার না চলায় গ্যারেজে কাজ নিতে হয় ভদ্র ও শান্তশিষ্ট রাকিবকে। দিনে কাজ করত, আর রাতে বাসায় ফিরে করত পড়াশোনা। ১২ বছরের ছোট্ট শরীরে দিনভর বহু পরিশ্রম করেও পড়ালেখা ছাড়েনি। কারণ তার স্বপ্ন ছিল, একদিন বড় কিছু হয়ে পরিবারের দুঃখ ঘোচাবে।
এভাবেই চলছিল। কিন্তু গ্যারেজ মালিকের দুর্ব্যবহার ও কম পারিশ্রমিক দেওয়ায় কাজ ছেড়ে দেয় সে। এই কাজ ছাড়ার ‘অপরাধে’ গতকাল সোমবার রাকিবকে নগ্ন করে, মলদ্বার দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে হাওয়া দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। urgentPhoto
খুলনার সরকারি টুটপাড়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত রাকিব। একই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তার ছোট বোন লিনা। চার/পাঁচ মাস আগে সংসারের ভার কাঁধে নিতে হয় রাকিবকে। আর এ জন্য স্কুল যাওয়া বাদ দিয়ে ওই গ্যারেজে কাজ নেয় সে। তারপরও দিনে কাজ শেষ করে রাতে বাড়িতে ফিরে পড়তে বসত সে।
নগরের টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের একাধিক বাসিন্দা ও রাকিবের প্রতিবেশীরা জানায়, দরিদ্র পরিবারের সন্তান রাকিব ভদ্র ও শান্তশিষ্ট ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সেই সংসারের ভার কাঁধে আসায় কাজ শুরু করতে হয়েছিল তাকে।
তারপরও রাতে পড়ালেখা করত সে।
আজ মঙ্গলবার সকালে রাকিবের বাসায় গিয়ে দেখা যায় লোকে লোকারণ্য। সিলেটে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যার ঘটনার পর অমানুষিক নির্যাতন করে শিশু রাকিবকে হত্যার এই ঘটনার প্রতিবাদে নেমে এসেছেন খুলনাবাসী। নিহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে দলমত নির্বিশেষে শত শত মানুষ আসে রাকিবদের বাড়িতে। মানুষের চাপে টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। দায়ীদের ফাঁসির দাবিতে ফেস্টুন আর পোস্টারে ছেয়ে যায় পুরো এলাকা।
বাড়িতে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আহাজারি করছিলেন রাকিবের মা লাকি বেগম। তাঁকে ঘিরে ছিল আশপাশের এলাকার নারীরা। ক্যামেরা দেখতেই চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘কীভাবে মারিছে সেই দৃশ্য তো আপনারা দেখিননি… আমার বাচ্চাডারে… আরে আল্লারে, পাছার মধ্যি নল ঢুকোইয়ে দেছে, গ্যাস দিয়ে দেছে। আহারে, কয় আমারে একটু বাঁচাও। আরে আর্তনাদ করিছে আমার বাচ্চডা। রক্ত...রক্ত ভাইসে গেছে রে...’
রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম এনটিভিকে বলেন, ‘আমার ওইটুকু মাসুম বাচ্চা কারোর তো ক্ষতি করিনি। আর আমিও তো কারোর ক্ষতি করিনি যে আমি বিচার চাব না। আমার বিচার চাইতেই হবে। এর এমন শক্ত বিচার হোক যেন আর কোনো মার কোলের থেকে সন্তান ডেকে এনে যেন হত্যা না করে।’
নুরুল আলম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, যেকোনো প্রকারে সন্তান হত্যার বিচার চান তিনি। রাকিবকে জোর করে ধরে দোকানে নিয়ে প্যান্ট খুলে তার মলদ্বারে পাইপ ঢুকিয়ে হাওয়া দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। নুরুল আলম বলেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও চিৎকার করেও কারো মন গলাতে পারেনি রাকিব। মলদ্বারে নল ঢুকানোর কারণে রক্ত বের হতে থাকে।’
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা রাকিবকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন জানিয়ে নুরুল আলম বলেন, তার আগেই তো সে মারা গেল।
হত্যা মামলার এজাহারে যা আছে
রাকিব হত্যার ঘটনায় তার বাবা মো. নুরুল আলম খুলনা থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে তিনি জানান, তিনি স্ত্রী লাকি বেগমকে নিয়ে টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডে বসবাস করেন। তাঁদের সংসারে রাকিব (১২) আর লিনা কন্যা (৮) সন্তান রয়েছে। তিনি নিজে পেশায় গাড়ি চালক। সংসারের টানাপড়েন মেটাতে ছেলে রাকিব স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে চার পাঁচ মাস আগে টুটপাড়ার শরিফ মোটর্স নামের একটি মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেন্টারে হাওয়া দেওয়ার কাজ নেয়। কিন্তু মালিক মো. শরিফের আচরণ খারাপ হওয়ায় এবং কম পারিশ্রমিক দেওয়ায় সেই কাজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ে নুরুল আলম মোটর্স নামের আরেকটি গ্যারেজে কাজ নেয় সে। এ ঘটনায় শরিফ ক্ষিপ্ত হয়ে রাকিবের মাসহ পরিবারকে কয়েক দফা হুমকি দেন।
গতকাল সোমবার বিকেলে নতুন কর্মস্থলের হয়ে রাকিব রং কিনতে বের হয় সাইকেল নিয়ে। পুরাতন কর্মস্থল শরিফ মোটর্সের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শরিফ তার সাইকেল টেনে ধরে আটকে রাখে। পরে রাকিবকে দোকানের ভেতর নিয়ে হাওয়া দেওয়ার পাইপ মলদ্বারে ঢুকিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয়। এই সময় আরেক আসামি মন্টু খান রাকিবকে জাপটে ধরে। ফলে হাওয়া ঢুকে রাকিবের পেট, মুখ ও দেহের বিভিন্ন অংশ ফুলে যায়। এই সময় রাকিবের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে খুলনা সদর হাসপাতাল, পরে একটি ক্লিনিক এবং সবশেষ খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখানেই তার মৃত্যু হয়।
এদিকে রাকিবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে রাতেই এলাকাবাসী মো. শরিফ ও মন্টু খানকে ধরে পিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. শরিফের মা বিউটি বেগমকেও আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
ঘটনার সময় নিহত রাকিবের বাবা খুলনার বাইরে থাকায় আজ মঙ্গলবার খুলনা থানায় আটক তিনজনের নামে তিনি হত্যা মামলা করেন। আটক তিনজনকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এদিকে আজ সকালে রাকিব হত্যার খবর পেয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান মিজান, সাবেক সংসদ সদস্য মহানগর বিএনপি সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, খুলনা মহানগর পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝিসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতারা রাকিবের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে আসেন।
খুলনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবু সুকুমার বিশ্বাস জানান, এজাহারভুক্ত তিনজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার আলামত হাওয়া মেশিনের পাইপটি জব্দ করা হয়েছে। দ্রুতই এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।