‘সমগ্র বাংলাদেশ অপরাধবোধে ভুগছে’
কখনো কখনো যেন মানুষই হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ যমদূত। নিজের সন্তান বা ছোট ভাইয়ের মতো একজন রাজন, রাকিব বা রবিউলদের ওপর চালায় নির্মম নিষ্ঠুরতা। মারতে মারতে মেরেই ফেলা হয় তাদের। এসব ঘটনার কিছু কিছু উঠে এসেছে সামাজিক মাধ্যমে। উঠে এসেছে গণমাধ্যমেও। কিন্তু এমন আরো ঘটনা যে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
রাজন, রাকিব বা রবিউলের মতো শিশুদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে মৃত্যুর হাতে কোলে দেওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বছরের পর বছর দ্রুততার সঙ্গে বিচার নিশ্চিত করতে না পারায় এমন নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ড বেড়েই চলেছে বলে মনে করেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। আর সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এমন ঘটনা প্রমাণ করে দেশে এখন মূল্যবোধের সংকট চলছে। তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে সমাজব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে পড়বে বলেও আশঙ্কা তাঁদের।
শিশুদের নিয়ে কাজ করা শিশু অধিকার ফোরামের হিসাবে, বছর বছর নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয় দুইশরও বেশি শিশুকে। বছর বছর যেন তা বেড়েই চলেছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত এমন নির্মম মৃত্যু যন্ত্রণার শিকার হয়েছে ১৯১ জন। বছর শেষে তা কততে গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়েই যত শঙ্কা তাদের! আর ওই সংস্থার হিসাবেই, মৃত্যু না হলেও বছর বছর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে কমপক্ষে হাজারখানেক শিশু।
এ বিষয়ে ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আজকে কিন্তু এই ঘটনাগুলোকে আর বিচ্ছিন্ন বলা যায় না। যদি কেউ বলেন যে এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা তবে সেই মতবাদের সাথে আমি সম্পূর্ণ জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করি। কেননা এত বেশি এগুলো ঘটছে এবং এই সবগুলো কিন্তু একটা যদি আপনি এগুলো নিয়ে চিন্তা করেন, একটু গবেষণা করেন তাহলে দেখবেন এগুলো একটা সূত্রে কিন্তু গাঁথা এবং সেই সূত্রটি হচ্ছে যে আমার বিচার হবে না, আমি এটা করলেও। আমার এমন প্রভাব আছে যে আইন আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আজকে যদি আমরা বিচার করতে পারতাম, আমরা যদি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতাম যে দোষী যে যেই হোক না কেন আইন অনুযায়ী তার বিচার হয়, তাকে শাস্তি পেতে হয়, তাহলে কিন্তু এই কর্মকাণ্ড হতো বলে আমার মনে হয় না।’
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে দেশের প্রেক্ষাপটে কঠিন এক বাস্তবতা হচ্ছে, এ ধরনের নির্যাতন আর অমানবিক ঘটনা কোথাও না কোথাও, সব সময় ঘটছে। কখনো আলোচনায় আসছে ইভ টিজিং, কখনো মেয়েশিশুদের পাশাবিক নির্যাতন, কখনো রাজন রাকিবদের মতো ঘটনা।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, ‘সমগ্র বাংলাদেশ একটা কাইন্ড অব গিল্ট ফিলিংয়ে (এক ধরনের অপরাধবোধ) ভুগছে। সমাজ তখন সে অপরাধবোধে যখন ভুগতে থাকে তখন এগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। এবং অপরাধবোধ কিন্তু মানুষকে একরকমের মুক্তি দেয়। কিন্তু এইটা কিন্তু আল্টিমেট সলিউশন (চূড়ান্ত সমাধান) দেয় না। সমাজের যে সমস্ত মূল্যবোধগুলোকে আমরা সাংঘাতিক রকমভাবে গুরুত্ব দেই, সেই মূল্যবোধগুলোর চর্চা থেকে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং সেই মূল্যবোধ চর্চা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি কিংবা হোঁচট খাচ্ছি বলেই কিন্তু রাবিক হত্যা, রাজন হত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটছে।’
ড. মনিরুল আরো বলেন, ‘সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কিন্তু এটা একটা সংকট এবং সেই সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটটাকে যদি আমাদের নিরসন করতে হয় তাহলে অবশ্যই আমাদের নেতৃত্বকে জেগে উঠতে হবে।’
সমাজবিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, সবাই এখন শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছে। ‘আমি আমি’ করতে করতে আমরা কথাটাই যেন হারিয়ে যাচ্ছে মনের গহীন থেকে। কিন্তু সেই আমিত্ব নিয়ে চলা মানুষের মনের গভীরে কোথাও শেষবেলায় শিশু রাজনের একটু পানি পানের আর রবিউলের মৃত্যুযন্ত্রণা কমানোর যে আকুতি, তা কি দুঃস্বপ্নের ঘণ্টা বাজিয়ে যাবে না আরো বহু বছর?