সংসদের স্থায়ী কমিটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও অকার্যকর : টিআইবি
রাষ্ট্রযন্ত্রের মতো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। এ জন্য সংসদীয় কমিটি কার্যকর হচ্ছে না। এ ছাড়া আইনি জটিলতা, অনেক সুপারিশ ব্যক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট হওয়ায় এবং কমিটিগুলো অকার্যকর থেকে যাচ্ছে।
আজ রোববার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কার্যকারিতা : চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্রে এসব উল্লেখ করা হয়। গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন ফাতেমা আফরোজ ও জুলিয়ট রোজেটি। এ সময় টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি বিগত নবম ও চলতি দশম সংসদের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সংসদীয় কমিটির কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে সভাপতি ও সদস্য নির্বাচনের সময় তাঁদের দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা দেখা হয়নি। এ ছাড়া কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারি দল এবং দলীয় প্রধানের প্রভাব লক্ষণীয়।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের মতো সংসদীয় কমিটিও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ সব ক্ষমতা একজনের হাতে। এ জন্য সংসদীয় কমিটিগুলো কার্যকর হচ্ছে না। এ ছাড়া সংসদীয় কমিটিতে বিভিন্ন ব্যক্তিকে তলব করা হলেও হাজির হওয়া বাধ্যবাধকতা না থাকায় অধিকাংশ ব্যক্তিই উপস্থিত হন না।’
সংসদের বর্তমান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমান বিরোধী দল একই সঙ্গে সরকারেও আছে। তাই তাদের নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুতরাং তাদেরই প্রমাণ করতে হবে তারা সত্যিকার অর্থে বিরোধী দল কি না।’
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা ভালো না। এ জন্য একের পর এক ব্লগার হত্যা করা হচ্ছে। আর ৯১-এর পর থেকে ক্ষমতা এককেন্দ্রিক অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনিই একাধারে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান আবার সংসদের নেতাও। দেশে আসলে নির্বাচিত স্বৈরাতন্ত্র চলছে।’
টিআইবির গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারি দলের এবং দলীয় প্রধানের প্রাধান্য লক্ষণীয়। বিরোধী দলের সদস্যরা প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় বা কার্যকর হচ্ছে না।
কমিটি অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তির হয়ে কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সব কমিটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না।
এসব থেকে উত্তরণের জন্য টিআইবি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো সংবিধানের ৭৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইন করে সাক্ষী হাজিরা, সাক্ষ্য প্রদান এবং দলিলপত্র দেওয়ার বাধ্য করার ক্ষমতা কমিটিকে দিতে হবে।
স্থায়ী কমিটিগুলোর অন্তত ৫০ শতাংশ কমিটি বিশেষ করে আর্থিক কমিটিতে বিরোধী দলের মধ্য থেকে সভাপতি নির্বাচন করতে হবে। এ ছাড়া সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি সংশোধন করে কমিটিকে শক্তিশালী করতে হবে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, নবম ও দশম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সব কমিটি ও দশম সংসদের দলীয় প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে সদস্য নিযুক্তির ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ গৃহীত হলেও আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিকসহ বিবিধ চ্যালেঞ্জের কারণে কমিটির ওপর সার্বিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় কমিটিগুলো কার্যকর হচ্ছে না।
নবম সংসদের পুরো মেয়াদ এবং দশম সংসদের ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কমিটিগুলোর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে টিআইবি বলছে, রাজনৈতিক বা দলীয় প্রভাব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সদস্য কর্তৃক বা মন্ত্রণালয় কর্তৃক কমিটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা, কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা না থাকা, হাজিরা সাক্ষ্য প্রদান ও দলিলপত্র প্রদানে বাধ্য করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা না থাকা ইত্যাদি কারণে বাস্তবে এই কমিটিগুলো প্রত্যাশিত পর্যায়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটির সদস্য নির্বাচনের সময় তাঁদের দক্ষতা যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি কিছুই দেখা হয় না। এবং কমিটির সভাপতি ও সদস্য নির্বাচন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরকারি দল ও দলীয় প্রধানের প্রভাব লক্ষণীয়। সভাপতি নিয়োগে সংসদে দল অনুযায়ী আনুপাতিক হারের তুলনায় বিশ্লেষণে দেখা যায়, সদস্য হিসেবে নবম সংসদে ১১ শতাংশ ও দশম সংসদে ১৭ শতাংশ বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং সভাপতি হিসেবে যথাক্রমে তা ছিল ৪ শতাংশ ও ২ শতাংশ। নবম সংসদে ১১টি কমিটি মোট ৩১ বার এবং দশম সংসদের তিনটি কমিটি মোট তিনবার পুনর্গঠিত হলেও কমিটি পুনর্গঠনের কোনো কারণ প্রকাশিত হয়নি। এ ছাড়া মাসে অন্তত একবার বৈঠক করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ কমিটিই তা করেনি এবং সদস্য বা সভাপতি বৈঠকে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনিয়ম দেখা গেছে।
গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বিধিবহির্ভূতভাবে নবম সংসদের ৫১টির মধ্যে ছয়টি এবং দশম সংসদের ৫০টির মধ্যে পাঁচটি কমিটিতে সদস্যের কমিটি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। কেস হিসেবে গৃহীত ১১টি কমিটির মধ্যে নয় কমিটির ১৯ জন সদস্যের ব্যবসাসংক্রান্ত সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, স্থায়ী কমিটির দায়িত্ব থাকলেও নবম ও দশম সংসদে কোনো বিলের জনমত যাচাই-বাছাই করা হয়নি। উল্লেখিত ১১টি কমিটির সুপারিশক্রমে ৭৩টি বিল পাস হয়েছে, যার মধ্যে ৬৯টি বিলে সংসদ সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব দিলেও ৩৭টি বিলের ক্ষেত্রে প্রস্তাব অধিবেশনেই কণ্ঠভোটে নাকচ হয় এবং ৩১টি বিলের ক্ষেত্রে সদস্য অনুপস্থিত থাকার প্রস্তাব সংসদের অধিবেশনে উত্থাপিত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিধিতে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
গবেষণাপত্রে বলা হয়, কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে বিশ্লেষণ অনুযায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের বড় অংশই বাস্তবায়িত হয় না। কেস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১টি কমিটি নবম সংসদে মোট ১৮৯১টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। যার মধ্যে ৪১ শতাংশ বাস্তবায়িত হয় এবং নবম সংসদ শেষ হওয়া পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন ছিল ২০ শতাংশ। গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে দুর্নীতি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত তুলনামূলকভাবে কম (৪ শতাংশ) ছিল। এ ধরনের সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব যেমন লক্ষণীয় তেমনি জবাবদিহিতার পরিবর্তে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিকে রক্ষায় কাজ করার এবং তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণ হলেও তার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে।