করোনাভাইরাস : আমরা কেন গুজবে কান দেব?
বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্মরণকালের ভয়াবহতম বিপর্যয়কাল পার করছে। চীন থেকে শুরু হওয়া করোনা তথা কোভিড-১৯ ভাইরাস বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে। এটা সত্য যে, এই ভাইরাসে হাজার চারেক মানুষের প্রাণহানির পরও বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসাসেবায় ভালো হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। কিন্তু প্রাণঘাতী এই রোগটির বিস্তার ও সংক্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিনই তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে নানামুখী নির্দেশনা জারি করে যাচ্ছে। এ ভাইরাস বৈশ্বিক সমাজব্যবস্থা, রীতি, আদবকেতা, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মারাত্মক বাঁকবদল ঘটিয়ে যাচ্ছে।
তারপরও বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) আওতায় জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জাতীয় কমিটি ছাড়াও জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় সব জেলা হাসপাতালে স্থাপন করা হয়েছে আইসোলেশন ইউনিট।
তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর অবশ্য দুজনকে পুরোপুরি সুস্থ ঘোষণা করা হয়েছে। যা হোক, অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে পূর্বঘোষিত বড় প্রোগ্রাম পুনর্বিন্যাস করেছে।
আর এই সুযোগে সোশ্যাল মিডিয়া নানামুখী গুজবে ভরে উঠেছে। গুজববিলাসী বাঙালি সেসব কথন-অতিকথন বিবেচনায় না নিয়ে দেদার বিলিবণ্টন করছে। ফেসবুক ও ইউটিউবাররা সবাই যেন এখন করোনা বিশেষজ্ঞ। যে যেভাবে পারছে অসুখের মর্মবাণী ও প্রতিকার-পদ্ধতি বর্ণনা করে যাচ্ছে। এবং এটা ঘটছে সরকারি ও দায়িত্বশীল প্রচারসংস্থার এক ধরনের নীরবতার কারণেই। এতে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অপ্রয়োজনেও মাস্ক ও স্যানিটাইজারের পেছনে পঙ্গপালের মতো সবাই ছুটছে। আর এই সুযোগটাই লুফে নিয়েছে সুযোগসন্ধানী, ধুরন্ধর ও অসাধু ব্যবসায়ীরা। নাকে-মুখে ব্যবহার করার স্বল্পমূল্যের মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাধারণ মানুষকে কিনতে হচ্ছে বহুগুণ দামে। দেশের কোথাও কোথাও লোভী ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের মজুদদারির কারণে এসব স্বাস্থ্য-অনুষঙ্গ বহুমূল্য ব্যয় করেও মিলছে না। সামর্থ্যবানেরা এই আগুনে ঘি ঢেলে দিয়ে চড়া দামে কিনে মাস্ক ও স্যানিটাইজারে বাড়িগাড়ি বোঝাই করছে।
এই হলো আমাদের বিবেক ও বোধ। একা ভালো থাকার অশুভ প্রবণতা এ সময়ের বাঙালির বড় অসুখ। এই অসুখটাই সবাইকে ঘায়েল করতে পারে, করোনা নয়। অথচ এখানে মানুষ থাকলে তারা ন্যায্যমূল্যে এসব মেডিকেল ইকুইপমেন্ট বিক্রি করত এবং সমাজের ধনিক শ্রেণিরা তাদের তুলনায় সুবিধাবঞ্চিত ও গরিবদের কথা মনে রাখত। একলা বেঁচে থাকার নাম জীবন হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের মতো সুশোভন জীবনবাদী কাঠামো সৃষ্টি হতো না। আমাদের মানবিক ধর্মবোধ বড় প্রশ্নবিদ্ধ। ঠেকে নাকি মানুষ শেখে। আমরা আর কবে ভব্যতা, সভ্যতা ও মহানুভবতা শিখব?
গণমাধ্যমগুলোর খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আমাদের পাশের দেশ ভুটানে গেল ৬ মার্চ এক ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর প্যানিক না হয়ে সচেতনতা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশটিতে। পরদিনই রাজধানী থিম্পুতে প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং নিজেই একটি পিকআপভ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণের মধ্যে জীবাণুনাশক হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করা ছবিতেও দেখা যায়, ওই দিন তিনটি স্পটে জনপ্রতি ১০০ মিলিলিটার করে বিনামূল্যে জীবাণুনাশক বিতরণ করা হয়েছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও এতে জানানো হয়। জীবাণুনাশক সংগ্রহ করতে কমলা রঙের পোশাক পরিহিত কর্মীদের কাছে পাত্র নিয়ে হাজির হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি দেশের ধনী ব্যক্তিদেরও অসচ্ছল মানুষকে মাস্ক ও জীবাণুনাশক দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানায় ভুটান সরকার।
আর আমরা কোথায় আছি! সরকারকে আপৎকালীন নীতিনির্ধারণে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি কে কোথায় বেশি দামে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিক্রি করছে, সেটার মোবাইল কোর্ট করতে হচ্ছে। শঙ্কিত হওয়ার আগে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। এই জন্য যে, সরকারকে এ সময় পাবলিকের অসাধুতার সালিশে নামতে হচ্ছে।
দেশে এ পর্যন্ত কেউ বিনামূল্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজার সহযোগিতার কথা ভাবল না। বড় ব্যবসায়ীরা দেশের মানুষ ও সরকারকে সহযোগিতার ঘোষণা দিল না। সবাই কেমন ঝিম মেরে বসে আছে। যদি রোগটা চীনের মতো মহামারি রূপ নেয়, তার পরিণতি কী হতে পারে, আমরা কল্পনাও করতে পারি না। অন্তত মৃত্যদূতের কাছে এসে মহাপাতক ও পাপিষ্ঠও সত্যনিষ্ঠ হয়। অথচ অর্থের ধান্ধাই আমাদের শেষ কথা। কীসের মরণ, কীসেরই বা জীবন! বিস্ময়কর বোধের অবনমন আমাদের। এই পোড়াভূমে তাই সভ্যতার মহামুক্তি সুদূরপরাহত।
তার পরও প্রকৃতির ভয়াল অভিশাপ করোনাভাইরাসের ভয়াল বিপাক থেকে হয়তো আমরা রেহাই পাব। জীবনবিমুখ না হয়ে সেদিন পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও শুদ্ধতায় জীবনবাদিতারই জয়গান করব সবাই। করোনার ভয়াল দুর্বিপাক থেকে বিশ্বসমাজ ও আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ মুক্তি পাক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন