আল্লামা শফীর মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি
হেফাজতে ইসলামের সাবেক আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁর অনুসারীরা। আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন আল্লামা শফীপন্থিরা। লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন আহমদ শফী।
লিখিত বক্তব্যে মাওলানা ইউসুফ বিন আহমদ শফী বলেন, ‘আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্ত হতে হবে। যারা এই তদন্তের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেননা তদন্ত কাজে বাধাদান এবং এ জাতীয় হুমকি-ধামকি স্বাধীন ও স্বাভাবিক বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।’
গত ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় এক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে আল্লামা আহমদ শফীর ছেলে ও মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক পদ থেকে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পরের দিনও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে মাদ্রাসা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্রদের বিক্ষোভ বন্ধ না হওয়ায় পরের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর রাত ১২টার দিকে মহাপরিচালক আহমদ শফী নিজেই তাঁর পদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন।
পরবর্তী সময়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে আহমদ শফীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে আহমদ শফীকে ঢাকায় নেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগ এনে গত ১৭ ডিসেম্বর হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিবসহ ৩৬ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে মামলা হয়। চট্টগ্রামের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ৩ নম্বর আদালতের বিচারক শিবলু কুমার দে ঘটনা তদন্তে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার বাদী আল্লামা শফীর শ্যালক মঈন উদ্দিন জানান, মামলায় তিনটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনা হেফাজতের বর্তমান আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর ইন্ধনে হয়েছে বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
মামলায় এক নম্বর আসামি করা হয়েছে মাওলানা মো. নাসির মুনিরকে। আর দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতার জন্য আলোচনায় আসা হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, কেন্দ্রীয় নেতা মীর ইদ্রিস, হাবিব উল্লাহ, আহসান উল্লাহ, জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর নামও রয়েছে আসামির তালিকায়।
মামলার অভিযোগে আরো উল্লেখ করা হয়, আসামিরা আল্লামা আহমদ শফীকে নাজেহালের পাশাপাশি তাঁর কক্ষ ভাঙচুর ও মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁর মুখ থেকে অক্সিজেন কেড়ে নিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁর অফিস থেকে বিভিন্ন মূল্যবান কাগজপত্রের পাশাপাশি ৬৮ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আনা হয়।
আজ আল্লামা শফীর মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে বিচারিক তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তাঁর অনুসারীরা। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, “জীবনের শেষ মুহূর্তে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে (আল্লামা শাহ আহমদ শফী) অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, ভাঙচুর করা হয়েছিল এসি-ফ্যানসহ আসবাবপত্র। চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছিল, মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে ফেলা হয়েছিল, হাসপাতালে যেতে বিলম্ব ঘটানো হয়েছিল। ১০০ বছর ঊর্ধ্ব এই বয়োবৃদ্ধ আলেমের নাতির গলায় ভাঙা কাঁচ ধরে বলা হয়েছিল, ‘এই বুইড়া, স্বাক্ষর কর, না হয় তোর নাতিকে হত্যা করব।’ এ কথা বলে জোর জবরদস্তিমূলক স্বাক্ষর নিয়ে তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। এসব কিছুর পরও কি বলতে হবে, আল্লামা শফীর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়েছে?”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আল্লামা শফীকে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সংগঠনটির বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরী। ২৩ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, যারা মামলা করেছেন তারা দালাল।
সংবাদ সম্মেলনে জুনাইদ বাবুনগরীকে হেফাজতে ইসলামের ‘তথাকথিত’ আমির উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, আল্লামা শফীর মৃত্যু নিয়ে মিথ্যাচার করছেন তিনি।
আল্লামা শফীর ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর পর হাটহাজারী মাদ্রাসার দায়দায়িত্ব ছিনিয়ে নিতে হেফাজতে ইসলামের নামে মামা-ভাগ্নের কাউন্সিল করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অবৈধ কমিটি করা হয়েছে বলেও সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ তোলা হয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘তথাকথিত এই কমিটিতে বাবুনগরীর পারিবারিক সদস্যই রয়েছে প্রায় ২২ জন। এ ছাড়া দুটি রাজনৈতিক দলের একটির ৩৬ জন, আরেকটির ২৪ জন সদস্যকে বিভিন্ন পদে পদায়িত করে হেফাজতকে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করা হচ্ছে।’
বিগত দিনে যারা বিভিন্ন আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন, সক্রিয় ছিলেন তাদের পাশ কাটিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ শফীপন্থিদের।
বাবুনগরীর কমিটিকে অবৈধ উল্লেখ করে নিজেদের হেফাজতের মূলধারার বলে দাবি করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অচিরেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে কাউন্সিল আহ্বান করে হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে।
সংবাদ সম্মেলন থেকে সরকারের কাছে চারটি দাবি জানান শফীপন্থিরা।
১. বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর রহস্য উদঘাটন করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা।
২. তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে করা মামলা তদন্তপূর্বক অবিলম্বে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে হবে।
৩. শফীর পরিবারের সদস্যদের ও তাঁর অনুসারীদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে।
৪. শফীর রেখে যাওয়া সব ধর্মীয় ও সামাজিক অঙ্গনগুলো থেকে তাঁর বিরোধীদের অপসারণ করতে হবে।