ভাষাপ্রেম এবং আত্মমর্যাদা
এমন নয় যে কেবল ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলি। তা ছাড়া বাকি ১১ মাস নিশ্চয়ই আমরা শুধু ইংরেজিতে লিখে যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করি না। তাহলে ভাষা আন্দোলনের মাস ফেব্রুয়ারিতেই আমরা কেন ভাষা-সচেতন হয়ে উঠি এবং নানা উদ্যোগ ও সক্রিয়তার সঙ্গে জড়িয়ে যাই। এ থেকে স্পষ্টত আমাদের মানসিকতা ও প্রবণতা সম্পর্কে ধারণা মেলে। আমরা প্রথমত আনুষ্ঠানিকতাকে মূল্য দিই। দ্বিতীয়ত, আমাদের মৌসুমি ভাবনা স্রেফ উপরে-উপরে, গভীর অভিনিবেশ ও মনন আমাদের চারিত্র্যে নেই।
আমি খোলাখুলি কথা বলতে চাইছি নিজেকে নিজেই ধাক্কা দেওয়ার জন্যে, আপন দর্পণের মুখোমুখি হতে। আর আমি মানে যে আমি একা নই, আমাদের বেশির ভাগ তথাকথিত আধুনিক শিক্ষিত সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণিই, সেটি খোলাসা করে না বললেও চলছে। এই আমার কথাই ধরুন। মার্চ থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ভাষাবিষয়ক লেখার জন্য, সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য কিংবা টিভি অনুষ্ঠানে যুক্ত হওয়ার জন্য কোনো আহ্বান/ আমন্ত্রণ পাই না। কিন্তু জানুয়ারি বিদায় নিয়ে ফেব্রুয়ারির সূর্য ওঠার সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় আমার ভাষাকেন্দ্রিক ব্যস্ততা, এ সবই গণমাধ্যমের প্রয়োজন পূরণে।
আমরা যদি দুর্ভাবনা, চাপ প্রয়োগ, সমালোচনা সব ফেব্রুয়ারির জন্যে তোলা রাখি, তাহলে ভাষার দূষণকারী, ভাষাকে উপেক্ষাকারী এবং ভাষার বিরোধিতাকারী এগার মাস তো নিরাপদেই থাকবেন। তাই আমি যদি বাংলা মায়ের সন্তান হয়ে থাকি, আমার ভাষা যদি হয় বাংলা আর বাংলাদেশের ওপর আমার আস্থা বজায় রাখি, তাহলে যেমন বারোটি মাসই বাংলা ভাষা ব্যবহার করি, তেমনি বারো মাস জুড়েই ভাষা-ভাবনা এবং এ-সংক্রান্ত সক্রিয়তায় আমাদের নিযুক্ত থাকতে হবে। তবেই আমরা সামনের দিকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে এগোব। আর তা না হলে স্বাধীনতার আরও ৫০ বছর পার করেও একই সংকট ও সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে জাবর কেটে চলব।
সমাজের সব স্তরে আমাদের রাষ্ট্রভাষা/ মাতৃভাষা কীভাবে চালু হবে? সোজা হিসাব। প্রথমত যাঁরা বাঙালি হয়েও বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গেই সার্বিক দাপ্তরিক কাজ বাংলা এড়িয়ে করে চলেছেন, তাঁদের শনাক্ত করা। আপনি ব্যাংকে টাকা তুলতে গেলে ইংরেজিতে বা হিন্দিতে কথা বলে কাউকে ভড়কে দিচ্ছেন না। তাঁরা বাংলাতেই সংযোগ স্থাপন করে আপনার কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করছেন। তার মানে আমি বলতে চাইছি না যে, আমাদের ব্যাংকগুলো সব কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আসা মহাভাষাপ্রেমিক। না, তা নয়। খেয়াল করলেই বুঝবেন, কর্মচারী/ কর্মকর্তা সেবাদানের লক্ষ্যে আপনার সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁর ভাষা শুদ্ধ নয়, তিনি মিশ্র ভাষা ব্যবহার করছেন। আঞ্চলিকতাও রয়েছে তাঁর বাচনে। যেসব কাগজপত্র আপনাকে পূরণের জন্যে দেওয়া হচ্ছে, সেসবে হয় বাংলা অনুপস্থিত রয়েছে কিংবা বাংলার সঙ্গে ইংরেজিও সংযুক্ত। তার মানে পরিষ্কার, আপাতভাবে যে প্রতিষ্ঠানকে আপনার মনে হলো মাতৃভাষাবান্ধব, সেখানেও আপনি গলদ পেলেন।
এবার আসুন পরের পরিসরে। ফেব্রুয়ারি এলে সর্বত্র শুনবেন যে সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন হচ্ছে না। এ নিয়ে হাহাকার। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ বাঙালি বিচারকরা বাংলায় রায় লিখছেন না। নির্দেশনা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। এখানে কাকে দুষবেন? উকিল কিন্তু আপনাকে দারুণ এক যুক্তি দেবেন যে তাঁরা আইন পড়ে এসেছেন ইংরেজিতে। বাংলায় নয়। তা ছাড়া বহু বিষয় বাংলায় অনূদিত হয়নি। তাই বাংলায় মামলা পরিচালনা করা গেলেও বাংলায় বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের শুনানি গ্রহণ করা হলেও রায় লেখার সময় সেটি কিছুতেই বাংলায় লেখা যাচ্ছে না। আমরা বলব, বাংলায় লেখা যায় যদি আপনি সেটি ইচ্ছে করেন।
আপনার বাংলায় লেখা আসে না দীর্ঘকালের অনভ্যস্ততায়। তাহলে অনুগ্রহ করে অভ্যস্ত হয়ে উঠুন। বাংলা যিনি জানেন, তাঁর সহায়তা নিন। অবশ্যই সম্ভব হবে। বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর মতো কথাবার্তা বলে আমি নেতিবাচকতাকে আহ্বান করব না। বলব, অতীতে যা হয়নি, আগামীতে তা সম্ভব করুন। করা সম্ভব।
আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম বাংলায় রাখুন। বাংলায় লিখুন নামফলক (সাইনবোর্ড)। হ্যাঁ, যদি বিদেশের সঙ্গে আপনার ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হয়, তাহলে আলাদা কথা। শুধু বিদেশিদের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানে ভিনভাষা ব্যবহার করুন। বাকি সব জায়গায় মায়ের ভাষাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন। এতে আপনার আত্মসম্মান বাড়বে। চিকিৎসকদের বাংলায় ব্যবস্থাপত্র লেখায় আপনি কি কোনো সমস্যা দেখেন? আমি অন্তত দেখি না। বিশ্বে ওষুধ রপ্তানিকারক দেশের তালিকায় সমীহ জাগানো অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ভেতর সরবরাহকৃত ওষুধের পরিচিতি ও নাম বাংলাতেই লেখা থাকে। চিকিৎসকেরা সদিচ্ছা পোষণ করলেই বাংলায় ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লেখা সম্ভব।
আসুন বহুজাতিক সংস্থার কথায়। বাংলাদেশে তারা ব্যবসা করতেই এসেছে। তাহলে বাংলায় কোম্পানিগুলোর যাবতীয় কাজ চলতে বাধা কোথায়? বিভিন্ন উৎপাদক সংস্থা, বণিকদের প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে অন্যতম কর্তাব্যক্তি ছাড়া বাদবাকি সবাই বাঙালি। তবে ওই একজনের দোহাই দিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত থাকা অন্যায় বলে পরিগণিত হবে না কেন? বাংলাদেশে বাংলাই চলবে, অন্য কোনো ভাষা তখনই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করবে, যখন সেটির কোনো বিকল্প থাকবে না। আপনি জার্মানিতে গিয়ে কাজ করুন, জার্মান ভাষা না শিখে কাজ করতে পারবেন? এখন ইউরোপ-আমেরিকায় স্প্যানিশ বা ফ্রেঞ্চ জানা ছাড়া উন্নতি করতে পারবেন না। শুধু ইংরেজির দাপট বিশ্বব্যাপীই কমে আসছে। অথচ আমরা সিন্দাবাদের সেই ভূতকে কাঁধ থেকে নামাব না বলে পণ করে বসে আছি।
স্বভাষাকে ভালোবাসুন, সেটি যথাযথভাবে শিখুন। তবেই না চর্চা। আমরা কেন ভুলে যাব, আমাদের স্বাধীন হওয়ার পেছনে, স্বতন্ত্র সম্মানজনক আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার পেছনে সবকিছুর আগে আমাদের মায়ের ভাষার যথাযথ আসন নিশ্চিত করতে হয়েছে। সেই লড়াইয়ে রক্তপাত ঘটেছে। সংগ্রাম সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দীর্ঘায়িত হয়ে যুক্ত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাই আমাদের ভাষার গুরুত্ব একমাত্রিক নয়। দেশের নিরানব্বই ভাগ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, স্বপ্ন দেখে, মাত্র এক শতাংশ সুবিধাবাদী লোকের জন্য সেই ভাষা থাকবে অবহেলিত। এই অনিয়ম এই অচলায়তন ভাঙতেই হবে। আগামী দিনের ছাত্ররাই সেই আন্দোলন সফল করে তুলবে, এমন প্রত্যয় জাগে। সেজন্যে যদি আরেকটা একুশে ফেব্রুয়ারি লাগে, তো লাগুক।
লেখক : সাংবাদিক