টিকা নিয়েও যে কারণে করোনা পজিটিভ হতে পারে
দেশে এখন করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) গণটিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে সরকার। এই কার্যক্রমের মধ্যেই খবর পাওয়া গেল, টিকা গ্রহণের পরেও দুজন ব্যক্তি ‘করোনা পজিটিভ’ হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা গ্রহণের পরও নানা কারণে একজন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা গ্রহণের ১২ দিন পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন এবং ১৫ দিন পর রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার সাজ্জাদ হোসেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মোহাম্মদ রশিদ–উন–নবী বলেন, ‘সাজ্জাদ হোসেন টিকা গ্রহণ করেন ৮ ফেব্রুয়ারি। টিকা নেওয়ার দিন থেকে তাঁর জ্বর ছিল, ছিল কাশিও। শরীরও দুর্বল ছিল।’
কাজী মোহাম্মদ রশিদ–উন–নবী বলেন, ‘আমার ধারণা, সাজ্জাদ টিকা নেওয়ার আগে থেকে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। হয়তো তখন উপসর্গ দেখা দেয়নি অথবা করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। আমার মনে হয়, তাঁর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে টিকা নেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি যখন তাঁর করোনা পজিটিভ আসে, তখন সাজ্জাদ মোটামুটি সুস্থ। এখনও সুস্থ রয়েছেন। তবে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’
করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’র সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলামের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় টিকা গ্রহণের পরও করোনায় আক্রান্তের বিষয়ে।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাভাইরাস কারো শরীরে প্রবেশের দুই থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত কোনো উপসর্গ দেখা নাও দিতে পারে। এটাকে সুপ্তিকাল বলে। তবে করোনায় আক্রান্তের পরপরই কারো শরীরে উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এমনও হতে পারে, যে দুজন আক্রান্ত হয়েছেন; টিকা গ্রহণের আগে তারা কোভিড পজিটিভ ছিলেন। আবার টিকা নেওয়ার পরও কিন্তু একজন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। এই কারণেই বারবার বলা হচ্ছে যে, টিকা গ্রহণের পরও যেন মাস্ক পরা বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয়।’
‘টিকা গ্রহণের ২১ দিনের মধ্যে করোনা হতে পারে’
টিকা গ্রহণের পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘টিকাটি গ্রহণের পর অন্তত তিন সপ্তাহ অর্থাৎ ২১ দিন পর্যন্ত ইমিউনিটি গড়তে সময় লাগে। এখন ধরে নেন, আপনি টিকা গ্রহণ করলেন। গ্রহণের ২১ দিনের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে আপনি গেলেন। এদিকে ভালোভাবে আপনার ইমিউনিটিও গড়ে উঠেনি। তখন কিন্তু আপনি করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন।’
‘হেভিলি ইনফেকটেড ব্যক্তিও নিরাপদ নয়’
জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির এই সদস্য বলছিলেন, ‘ধরেন, আমি টিকা নিয়েছি। কিন্তু আমার পাশে এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি হেভিলি ইনফেকটেড। মানে, ওই ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত। কোনো কারণে হয়তো আমি মাস্ক পরা ছিলাম না সে সময়। এখন এমন হতে পারে, আমার ইমিউনিটি পাওয়ার ওই মাত্রাতিরিক্ত ভাইরাসের কাছে হেরে যেতে পারে বা কাজ নাও করতে পারে। তখন কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। যদিও এমন ঘটনা হয়তো ১০ থেকে ২০ হাজারে একজন দেখা যাবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’
‘নানা রোগ থাকলে শঙ্কা বেশি’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ধরেন, একজন ব্যক্তি নানা রোগে আক্রান্ত। স্বাভাবিকভাবে তাঁর রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এমন অবস্থায় তিনি টিকা নিলেন। টিকা নেওয়ার পর তিনি হয়তো যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেননি অথবা করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির আশপাশে থেকেছেন। সেক্ষেত্রে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি না থাকায় তিনিও করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। যদি এমন হয়, তা হবে খুব রেয়ার কেস।’
‘টিকা শিরায় নিলে শঙ্কা থাকে’
‘মনে করেন, একজন ব্যক্তির শরীরে করোনার টিকাটি প্রয়োগ করানোর সময় কোনোভাবে শিরার ভেতরে পুশ করানো হলো। যদি এমন হয়, তাহলে কিন্তু মেডিসিনটি দ্রুতই চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে টিকাটি ভালোভাবে কাজ নাও করতে পারে। টিকাটি মূলত দিতে হয় মাংশপেশির মধ্যে। তাহলে টিকাটি কাজ করবেই। যদিও আমাদের যারা টিকাটি পুশ করছেন, তাঁদের এ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা দেওয়া হয়েছে’, যোগ করেন জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির এই সদস্য।
‘দ্বিতীয় ডোজের পর ঝুঁকি থাকবে না’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘টিকাটি গ্রহণের পর ইমিউনিটি বাড়তে শুরু করে। এভাবে আট সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজটি গ্রহণ করলে প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে। তখন আর কারো করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। যদিও এটা নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো গবেষণা নেই বিশ্বব্যাপী। আসলে এখনও পর্যন্ত অধিকাংশ দেশ প্রথম ডোজই দিচ্ছে। ভাইরাসটির বয়সও মাত্র এক বছর অতিক্রম করল। এসব নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে গেলে আরও সময় লাগবে।’
বাংলাদেশে করোনার এখন কী অবস্থা- এমন প্রশ্নে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা অন্যান্য দেশের চেয়ে খুবই ভালো অবস্থায় রয়েছি। আজ আমাদের শনাক্তের হার ছিল ২.৬৩ শতাংশ। একই অবস্থা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলছে। আমরা তো খুব বেশি স্বাস্থ্য সচেতন নই। সবাই মাস্কও পরে না। আবার ভীষণ ঘনবসতির একটি দেশ। সব মিলিয়ে আমার ধারণা, করোনা নিজেই আমাদের এখানে কন্ট্রোল হয়ে গেছে বা তার পাওয়ার কমে গেছে। নতুবা আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতরে দিয়ে যেতে হতো আমাদের।’