সাদা চোখে
সাকা-মুজাহিদ শেষ, কখন শুরু যথাসময়?
সাকা-মুজাহিদ পর্ব শেষ, ‘যথাসময়’ শুরু হতে আর কত বাকি? এ অপেক্ষায় গোটা দেশ। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর এ অপেক্ষার তর সইছে না দেশের সামাজিক যোগাযোগবান্ধব কোটি কোটি মানুষের।
মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসির রায় বহাল ঘোষণার পর নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে ১৮ নভেম্বর হঠাৎ অ্যানালগ করে দেওয়া হয় ডিজিটালমুখী বাংলাদেশকে। সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয় ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপসহ ১০টির মতো জনপ্রিয় মাধ্যম। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধ থাকবে বলে জানায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তা করতে গিয়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় সারা দেশে বন্ধ থাকে ইন্টারনেট সেবাও। বলা বাহুল্য, সরকারের লালসংকেতে সাময়িক ব্লকড এ মাধ্যমগুলো আবার খুলবে সরকারেরই সবুজসংকেতে। বিটিআরসি প্রথমে দেয় মৌখিক নির্দেশনা। পরে লিখিত নির্দেশনায় দেশের সব মোবাইল ফোন অপারেটর ও আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটরকে বলা হয় সামাজিক মাধ্যমগুলো বন্ধ করতে।
নির্জলা সত্য হচ্ছে, বন্ধ থাকার পরও একেবারে বন্ধ নেই ফেসবুকসহ জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপগুলো। সাধারণ ব্যবহারকারীরা এসব মাধ্যম থেকে ছিটকে পড়লেও প্রযুক্তি-জ্ঞানে এগিয়ে থাকা ব্যবহারকারীদের অনেকে এসব মাধ্যমে ঠিকই ঢুঁ মারছেন বিভিন্ন পন্থায়। সংশ্লিষ্ট মহলের না জানার কথা নয়, কোনো অ্যাপস বন্ধ করলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করার পর প্রক্সি সার্ভার দিয়ে অনেকে, বিশেষ করে তরুণরা নানাভাবে ঠিকই ফেসবুক ব্যবহার করেছে। সেটা একেবারে গোপন ঘটনা নয়।
অ্যাপসগুলো বন্ধের পর টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিরাপদ এবং স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত যতদিন প্রয়োজন, এসব মাধ্যম বন্ধ থাকবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের চেয়ে খানিকটা পরিষ্কার। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, দেশকে স্থিতিশীল করতেই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবার সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কথা আরেকটু আগ বাড়ানো। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যম বন্ধ থাকার বিষয়টি দেশবাসী একদিন বুঝতে পারবে।
মন্ত্রীদের প্রত্যেকের কথা আমলে নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে, সরকারের পরিস্থিতি নিরাপদ ও স্বাভাবিক হয়েছে মনে করতে আর কতদিন লাগবে? এ ছাড়া গত কদিনে বিষয়টি বুঝতে বুঝতে কাহিল হয়ে উঠেছে মানুষ। সরকার এ রকম কিছু করতে পারে, তা আন্দাজ করা যাচ্ছিল আরো বেশ কিছুদিন থেকেই। এ ঘটনার এক সপ্তাহ আগে ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এবং ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সে ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি জানান, প্রয়োজনে এসব যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখা হবে।
এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন বলা হয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপস ব্যবহার করতেন। এরও আগে ২০১২ সালে একবার ইউটিউব বন্ধ করে দেয়।
ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে কারফিউর মধ্যে মোবাইল ফোন সেবা সাময়িক বন্ধ করা হয়েছিল। এ ধরনের পদক্ষেপে আসলে ইতিবাচক কোনো উদ্দেশ্য সাধন হয় না। জনদুর্ভোগ-দুর্গতির পাশাপাশি সরকারের সমালোচনাই বাড়ে। দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার কোটি। এ ছাড়া অনলাইনে কেনাকাটা, বিভিন্ন বিল, শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি ফি পরিশোধকারীর সংখ্যা প্রচুর। অনেকেই এখন বেশি নগদ টাকা সঙ্গে রাখেন না। ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড পকেটে রাখেন। তা দিয়ে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলেন, কেনাকাটাও করেন।
তা ছাড়া ফেসবুকে পেজ খুলে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করা হয়। ইন্টারনেট ছাড়া তাদের এসব সব অচল। ইন্টারনেটে এক ঘণ্টার ধাক্কায় গার্মেন্ট, আমদানি-রফতানি, আউটসোর্সিংসহ বিভিন্ন খাতের ওপর দিয়ে ওই সময় ভালো ধকল যায়।
শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেই প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে সরকার এমনটি করে বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। তাঁর দাবি বেঠিক নয়। মোকাবিলার সামর্থ্য থাকার পরও কোনো দেশ এমনটি করে। এ তালিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের নামও আসবে। কিছুদিন আগে আমাদের প্রতিবেশী ভারতও অনেক ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছিল। পাকিস্তান পেশোয়ারে স্কুলে আক্রমণের পর তাদের সে অঞ্চলের মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ রেখেছিল। উত্তর কোরিয়া, ইরান, চীন, কিউবা, মিসর, সিরিয়া, মৌরিতাস, ভিয়েতনাম সরকারও বিভিন্ন সময়ে তাদের দেশে ফেসবুক বন্ধ করেছে। তবে এর ব্যতিক্রম তাজা উদাহরণও রয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা হলেও তাকে কেন্দ্র করে সে দেশের সরকার কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। তারা হয়তো উপলব্ধি করেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কোনো সমাধান নয়। সে ক্ষেত্রে আমরা ঘোষণা দিয়ে হার মেনেছি। তা যাদের ভয়ে এসব মাধ্যম বন্ধ করা, তাদের কাছে নৈতিক পরাজয় স্বীকারের মতো। এতে মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অনগ্রসরতার নমুনা স্পষ্ট হয়েছে। দুর্বলতা ধরা পড়েছে। এ দুর্বলতা না কাটালে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে।
ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি এ রকম কোনো ঝুঁকি দেখা দিলে এ ধরনের অপরাধ সামলানো অসম্ভব হবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সামর্থ্যের মধ্যেই ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আরো বেশি কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলা করা। অস্বীকার করার কোনো জো নেই, প্রযুক্তির জবাব সরকার প্রযুক্তির মাধ্যমে দেয়নি। প্রযুক্তিবান্ধব সরকারের জন্য এটি অশোভন। তা ডিজিটালযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই রুখতে হয়। বন্ধ করে এর সমাধান মেলে না কখনো।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।