‘ভাই, নিজেই কোরবানি হয়ে গেছি’
রাজধানীর বনশ্রীর বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে আফতাবনগরের গরুর হাটের প্রবেশপথ। হাটে ঢুকতেই চোখে পড়বে, ব্যবসায়ীরা সারি সারি গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। এটি আজ মঙ্গলবার অর্থাৎ ঈদের আগের দিনের বিকেলের দৃশ্য।
ভেতরের রাস্তা দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছিলেন, গরু ব্যবসায়ীরা হাঁক-ডাক করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। ব্যবসায়ীরা জানালেন, আজ বাজার খুব খারাপ যাচ্ছে। অধিকাংশ গরুই লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। ক্রেতারা অর্ধেক দাম হাঁকাচ্ছে বলে তাদের দাবি।
গাজীপুরের সানোয়ার হোসেন গত শুক্রবার সকালে ১৫টি গরু নিয়ে আসেন এ হাটে। বিক্রি হয়েছে মাত্র পাঁচটি। আক্ষেপ করতে করতে তিনি বললেন, ‘কোরবানির গরু হাটে বিক্রি করতে এসে নিজেই কোরবানি হয়ে গেছি। একটি গরু আমি নিজে কিনেছি এক লাখ ৯৬ হাজার টাকা দিয়ে। কিন্তু সেই গরুর দাম এখনো পর্যন্ত কেউ দেড় লাখের বেশি বলছে না। এখন পর্যন্ত বিক্রি করা পাঁচটি গরুতে আমার লস হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। বাকিগুলো বিক্রি না হলে বোঝেন কী অবস্থা হবে!’
আফতাবনগর হাটে আজ প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করে দেখা গেছে, বিক্রেতারা গরুর পাশে শুয়ে-বসে সময় পার করছেন। কেউ কেউ ক্রেতা ডাকাডাকি করছেন। মনে হল, যেন ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেশি। খুব একটা স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। অধিকাংশের মুখে যথাযথভাবে মাস্ক পরা ছিল না।
হাটের মধ্যে একটি নির্মাণাধীন ভবন রয়েছে। ভবনের নিচে অন্তত ৩০ জন গরু ব্যবসায়ী বস্তা ও খড়ের ওপর শুয়ে-বসে ছিলেন। সেখানকার ব্যবসায়ীরাও জানালেন, গতকাল রাত থেকে বিক্রি একদম কমে গেছে। তারা আশা করেছিলেন, ঈদের আগের দিন বেচাকেনা ভালো হবে। সেই আশাতে গরু আটকে রেখেছিলেন। কিন্তু গরু আটকে রেখে লোকসান বেশি হয়েছে বলে দাবি তাদের।
পাবনার সাঁথিয়া থানার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি মনসুর শেখ বলেন, ‘আর বলবেন না ভাই, তিনটি ট্রাকে করে মোট ৪৬টি গরু এনেছি এখানে। গতকাল রাত থেকে যে গরুগুলো বিক্রি করেছি, প্রত্যেকটিতে লস হয়েছে। একটি গরু ৩০ হাজার টাকা লস দিয়ে বিক্রি করেছি আজ। একটি গরু এখনও বিক্রি হয়নি। কেউ গরুটির দাম বলছে না। এখন যত কমই হোক, বিক্রি করে ঘরে ফিরব। মোট ৪৫টি গরুতে অন্তত ছয় লাখ টাকা লস হয়েছে এবার। গত কয়েক বছরে এমন লস খেতে হয়নি আমার।’
মনসুর শেখের পাশে আরও আটজন ব্যবসায়ী বসে ছিলেন। তারা সবাই পাবনা থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে আরেকজন মুকুল হোসেন। তিনি দাবি করেন, ‘মোট ১৩টি গরু এনেছি বাজারে। সব বিক্রি করে দিয়েছি। একটু আগে কেনাসহ খরচ হিসাব করে দেখলাম, এক লাখ তিন হাজার টাকা লস হয়েছে এবার।’
একটি ভবনের সামনে পাঁচটি গরু নিয়ে বসেছিলেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাশেম মোল্লা ও নূর আলম। পাঁচটি গরুই ফার্মের। ফার্মটির মালিক হেমায়েত মূলত এবার অনলাইনে গরু বিক্রি করছিলেন। অনলাইনে বিক্রি করতে করতে যেসব গরু আর বিক্রি হয়নি, সেই পাঁচটি গরু আনা হয়েছে আফতাবনগরের হাটে।
নূর আলম বলছিলেন, ‘সোমবার রাতে পাঁচটি গরু আনা হয়েছে, কিন্তু বিক্রি হয়নি একটিও। ক্রেতা নেই। অনলাইনে দেখিয়ে একটি গরুর দাম উঠেছিল আড়াই লাখ টাকা। গরুটির ওজন ১৫ মণ। আর এখানে ওই গরুর দাম বলছে দেড় লাখ টাকা। অনলাইন ব্যবসাই ভালো মনে হচ্ছে।’
কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন ইশায়াক শাহ। তিনি এই হাটে এ পর্যন্ত ১০ বার এসেছেন। তার অধিকাংশ গরুই বিক্রি হয়েছে গতকালকের আগে। অবিক্রিত থাকা কয়েকটি গরুর একটির ওজন ১০ মণ। ইশায়াক শাহ আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমার ১০ মণ ওজনের গরুর দাম ক্রেতারা ৭০ হাজার টাকা বলেছে আজ। শুনে খুব রাগ হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলতে পারিনি। কারণ, ক্রেতারা যা-তা বলতেই পারেন। গতকাল থেকে বেশ কয়েকটি গরুতে লস হয়েছে।’
তবে আজ ক্রেতাদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুলনামূলক কম দামে এখান থেকে গরু কিনেছেন তারা। তাদের মধ্যে একজন নাসির উদ্দিন। তিনি গতকাল সোমবার সকালে গাবতলীর গরুর হাটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দাম বেশি বলায় আর গরু কিনতে পারিনি। তিনি আজ আফতাবনগরে গিয়েছিলেন গরু কিনেছেন।
নাসির উদ্দিন বলেন, ‘৮৫ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছি আজ। প্রতি কেজি মাংসের হিসাব করলে দাম পড়েছে ৩৯০ টাকা করে। প্রায় সাড়ে পাঁচ মণ ওজন ধরে কেনা হয়েছে। অথচ গতকাল এমন গরুর দাম বলছিল অন্তত এক লাখ ৩০ হাজার টাকা।’
আরেকজন ক্রেতা শাহিন আলী গরু কিনে নিয়ে যেতে যেতে বলছিলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। অনেক কম দামে পেয়েছি। ভালোই লাগছে।’