হেলেনা জাহাঙ্গীরের মামলা ডিবিতে, জিজ্ঞাসাবাদ শুরু
আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) হস্তান্তর করা হয়েছে। মামলা তদন্তের স্বার্থে এরই মধ্যে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে ডিবি।
রোববার রাতে বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন ডিবির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্তি পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার তদন্তভার আমরা পেয়েছি। আজ সন্ধ্যায় গুলশান থানা পুলিশের কাছ থেকে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ডিবির হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
গুলশান থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও মাদকসহ অন্যান্য ধারার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয় হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। র্যাব বাদী হয়ে মামলা দুটি করে। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় হেলেনা জাহাঙ্গীর তিন দিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
হেলেনা জাহাঙ্গীরকে ডিবিতে হস্তান্তরের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, ‘আজ সন্ধ্যায় আমরা তাকে ডিবিতে হস্তান্তর করেছি।’
এ দুটি মামলার বাইরে গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে র্যাব-৪-এর একজন পরিদর্শক হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় আরেকটি মামলা করেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে হোটেল ওয়েস্টিনের পেছনে ৩৬ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বরে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। প্রায় চার ঘণ্টা অভিযান চলে। এ সময় তার বাসা থেকে বিদেশি মদ ও মুদ্রা, হরিণ ও ক্যাঙ্গারুর চামড়া, ওয়াকিটকি সেট এবং ক্যাসিনোর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয় বলে অভিযান শেষে জানান র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। ওই রাতের হেলানার মিরপুরের আইপি টিভি জয়যাত্রার অফিসেও অভিযান চালায় র্যাব।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর র্যাবের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দাবি করেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রথমে সখ্য তৈরি করতেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তারপর ব্ল্যাকমেইল করে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন তিনি। এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘হেলেনা সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির জন্য থেমে থাকেননি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য যাকেই প্রয়োজন হয়েছে, তাকে তিনি ঘায়েল করেছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন এবং সেটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছেন শুধু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য। আমাদের মামলার কারণ এটাই। সে রাষ্ট্রের ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন যা তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, জনগণের মধ্যেও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন এই মামলাটি র্যাব তদন্ত করবে তাহলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে আমরা আবেদন করব। তবে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে হবে।’
র্যাব কর্মকর্তা জানান, হেলেনা জাহাঙ্গীরের স্বামী ১৯৯০ সাল থেকে গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে অন্যদের সঙ্গে পার্টনারশিপের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করেন। এখন পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি।
খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি গত দুই বছরে বিভিন্ন মাধ্যম এবং টেলিভিশনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে, এজেন্সি দেওয়ার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা আদায় করতেন। কারও কাছ থেকে ১০ হাজার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা, আবার কারও কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছেন বলে আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। কী কারণে টাকা নিয়েছেন এবং কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে- এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জাহাঙ্গীর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘বাসায় এবং অফিসে যে পরিমাণ ভাউচার পাওয়া গেছে তা এখনো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। জয়যাত্রা টেলিভিশনের আইডি কার্ড ব্যবহার করে অনেক প্রতিনিধিও এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
হেলেনা জাহাঙ্গীরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘তাঁর ১৫ থেকে ১৬টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তিনি জড়িত। বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজি কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে আদায় করা টাকাগুলো তিনি ফাউন্ডেশনের কাজে লাগাতেন। সুনামগঞ্জে তিনি ত্রাণ বিতরণ করায় স্থানীয়রা তাকে পল্লীমাতা উপাধি দিয়েছেন। ফাউন্ডেশনের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে অনেক টাকা এনেছেন। এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।’
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ফ্ল্যাট কিংবা গাড়ির সংখ্যা কতগুলো সে বিষয়ে প্রকৃত কোনো তথ্য আমাদের দিতে পারেননি। কখনো ছয়টি গাড়ি, কখনো আটটি গাড়ির কথা উল্লেখ করেছেন হেলেনা। এসব বিষয়ে যারা তদন্ত করবেন তারা খতিয়ে দেখবেন। তার আয়ের উৎস সম্পর্কে সিআইডি কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি মনে করি।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি বক্তব্য উল্লেখ করে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘হেলেনার বক্তব্য খুবই উদ্বেগজনক। কাউকে এভাবে হেয়-প্রতিপন্নভাবে কথা বলা সমীচীন নয়।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যাচার, অপপ্রচার, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে অপপ্রচার এসব বিষয় হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোগ। আর আমাদেরও কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল যার পরিপ্রেক্ষিতে হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাসায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। তার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে মাদক, ওয়াকিটকি, চামড়া, ক্যাসিনো সরঞ্জাম উদ্ধার করি। হেলেনা জাহাঙ্গীর আইপি টিভি জয়যাত্রা কার্যক্রম ছিল সম্পূর্ণ একটি স্যাটেলাইট চ্যানেলের মতো। যার কোনো বৈধ সম্প্রচারের অনুমোদন ছিল না। জিজ্ঞাসাবাদে হেলেনা জানিয়েছেন, শিগগিরই তিনি এটা অনুমোদন পেয়ে যেতেন। অনুমোদন না থাকায় বিটিআরসি সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় এবং আমরা মালামাল জব্দ করে মামলা করেছি।’