কী কারণে চাকরি থেকে বের করে দিল আজও জানি না : মেজর (অব.) সামসুদ্দীন আহমদ
মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অন্যতম সাক্ষী। গ্রেনেড হামলার পর রাতে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁকে গ্রেনেডগুলো ডিসপোজাল করা এবং আলামত সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু, কিছুদিন পর নানা নাটকীয়তার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে তাঁকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়। সে সময়ের সেসব বিষয় নিয়ে সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের। এনটিভি অনলাইনের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ফখরুল ইসলাম শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনাটিকে বিভিন্ন সময় নানা খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘটনাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ের অভিজ্ঞতা যদি বলেন?
সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী : শুরুতেই স্মরণ করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি এটাকে এভাবে বলি—স্বাধীনতা পরবর্তী এবং স্বাধীনতার পর আমাদের যে প্রথম আঘাত, যে প্রথম শহীদ—তিনি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের মাগফিরাত কামনা করছি এবং আহতদের প্রতি সমবেদনা। সেদিন নির্দেশিত হয়ে আমি ঘটনাস্থলে যাই। আমাকে বলা হয়েছিল গিয়ে গ্রেনেডগুলো নিষ্ক্রিয় করার জন্য। গিয়ে তো ভয়াবহতা দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। তারপর সেখানে সেইফটি পিন লাগানো অবস্থায় একটি গ্রেনেড দেখতে পাই, যেহেতু পিন লাগানো, তার মানে গ্রেনেডটি সেইফ। আমি আমার কমান্ডকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কমান্ড তখন বলল—না এটা আনা ঠিক হবে না, ট্র্যাপ থাকতে পারে। পরে, আমি আমার মতো বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, পিন আছে, এটা সেইফ। এরপর আমরা চলে গেলাম গোলাপ শাহ মার্কেটের ওখানে, আমাকে বলা হলো সেখানে আরেকটি গ্রেনেড আছে। গোলাপ শাহ মাজারের ঠিক পাশেই একটি হকার্স মার্কেট, ওখানে একই অবস্থায় একটি গ্রেনেড ছিল। গ্রেনেডটি দোকানগুলোর মাঝখানে করিডরে। আমাকে বলা হয়েছিল, গ্রেনেডটি স্পর্শ না করে সেখানেই নিষ্ক্রিয় করার জন্য। আমি বললাম, সেখানে নিষ্ক্রিয় করা হলে দোকানে আগুন লেগে যেতে পারে। পরে গ্রেনেডটি আর সেখানে নিষ্ক্রিয় করা হয়নি। এ সময় অনেক সাংবাদিক ভাইয়েরা ছিলেন। তবে, আমাকে আগে থেকেই বলা হয়েছিল, আমি যেন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলি। এরপর আমি কমান্ডারকে জানাই, অনেক সাংবাদিক আছেন। তখন তিনি বলেন, ‘অল্প কথা বলো, বেশি কথা বলো না।’
আমি সাংবাদিকদের এ গ্রেনেডের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাই। এ গ্রেনেডগুলোতে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার স্প্লিন্টার থাকে। আর, এর একটি স্প্লিন্টারই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে।
পরদিন সকালে আমাকে আবার বলা হয়েছিল যে, আরও দুটি গ্রেনেড আছে, যদি পিন থাকে আর সেইফ মনে হয়, তাহলে নিয়ে এসো। পরে হকার্স মার্কেটের দোতলা থেকে একটি এবং জেলখানা থেকে আরেকটি গ্রেনেড নিয়ে আমরা ইউনিটে চলে এলাম। এরপর বিভিন্ন সংস্থা এসে গ্রেনেডগুলো দেখল। তারপর বিকেলে সেগুলো নিষ্ক্রিয় করা হলো।
পরবর্তী সময়ে ২৫ আগস্ট আমার বাড়িতে ডিজিএফআই’র সদস্যেরা আমার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে গেল। আমার আম্মা সেটি আমাকে ফোন করে জানান। তারা খোজ নিয়ে জানতে পারল, আমি ছাত্রলীগ করতাম, চুয়েট ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। আমি মুজিব আদর্শের সৈনিক, কিন্তু এটা তো কোনো অপরাধ নয়। এটাকে অপরাধ বিবেচনা করে কি না, কিংবা কী কারণে আমাকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হলো, কিছুই জানলাম না। যে দিন আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছে, সেদিনও জানলাম না, কী কারণে আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছে, আমার কী অপরাধ—কিছুই আমাকে জানানো হলো না। আজও জানি না।
তবে হ্যাঁ, আমি যখন যে প্রফেশনেই ছিলাম, তখন তা নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। আমি যখন ছাত্রলীগ করেছি—নিবেদিত কর্মী ছিলাম। আমি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেছি, একজন নিবেদিত সৈনিক হিসেবে কাজ করেছি। তো আমি একজন মুজিব আদর্শের কর্মী হিসেবে, একজন আর্মি হিসেবে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কোনো সহানুভূতির জন্য নয়।
এনটিভি অনলাইন : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে কাদের হাত থাকতে পারে বলে মনে করেন?
সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী : এদের (হামলাকারীদের) যথেষ্ট ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, এবং তারা নিশ্চয়ই নির্ভয়ে ট্রেনিং করেছে। তার মানে ওই সময় নির্ভয়ে ট্রেনিং করার অর্থ, অবশ্যই এখানে রাষ্ট্রীয় মদদ আছে। চট্টগ্রামে দশ ট্রাক অস্ত্র, সিরিজ বোমা হামলা—তখন যেন এসবের অভয়ারণ্য ছিল। তখন সহজেই এসব কাজ করতে পারবে, ট্রেনিং নিতে পারবে, সময়টা যেন তাদের জন্য স্বর্গরাজ্য ছিল। আমার মনে হয় না সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তখন এসব কাজ করা সম্ভব হয়েছে।
আপনারা জেনে থাকবেন, এখনও প্রশিক্ষণের সময় সৈনিকদের হাত কাঁপতে থাকে। যদিও প্রশিক্ষণ নেওয়া পর, তা আর থাকে না।
আমি দোয়া করি আল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখুক। দেশটা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই যেন উন্নত হয়ে যায়, এবং প্রধানমন্ত্রী তাঁর জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পারেন।
এনটিভি অনলাইন : এসব জঙ্গি হামলার পেছনে কি বিশেষ কারও প্রভাব কাজ করেছে?
সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী : বিভিন্ন ঘটনার আলামতগুলো তো তাই বলছে, কাজ করেছে। আপনি জানেন, কোনো একটা দলের উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান সাহেব বলেছেন—এগুলো তো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে, তাহলে এদের আসামি করা হয়েছে কেন? ওই সময় যারা ডিজিএফআই, এনএসআই-তে ছিল, তাদের আসামি করা হলো কেন। তার মানে তিনিই বলছেন, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে।
তবে, আমি আমার জায়গা থেকে বলতে পারি—এসব হওয়া উচিত নয়। এটুকু বলতে পারি—নাশকতামূলক কাজকর্ম করা উচিত নয়। যেটা লফুল (বৈধ) কমান্ড সেটা আমি মানব, কিন্তু যেটা লফুল কমান্ড নয়, সেটা তো আমি মানতে বাধ্য নই। সুতরাং আমার বিবেক কী বলে, আমার মনে হয় সেটাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার বক্তব্য অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের কারণেই আপনাকে চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়েছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় হয়েছে। আপনার কি মনে হয় এই মামলার সঠিক বিচার হয়েছে?
সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী : আমি মনে করি, এটার সঠিক বিচার হয়েছে এবং সময় নিয়ে প্রকৃত বিচারটাই হয়েছে। যথেষ্ট সাক্ষী, সাক্ষ্য ও আলামতের ভিত্তিতে বিচার হয়েছে।
মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) একজন সদস্য। তিনি ১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর চট্রগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাপাছড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আজিজ আহমেদ এবং মা আনোয়ারা বেগম। তিনি বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এরপর চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সামসুদ্দীন আহমদ ছোটবেলা থেকে পারিবারিকভাবেই প্রগতিশীলতা এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রাজনীতির চর্চা করতেন।
ছাত্রজীবনে সামসুদ্দীন আহমদ ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, ১৯৮৯ সালে পূর্ব ষোলশহর চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক, এবং ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।
চাকরি জীবনে সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী প্রথমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পাহাড়ে শান্তিরক্ষা, দিঘীনালার গঙ্গারামে ক্যাপ নির্মাণে কাজ করেন। তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের অধিনায়কের দায়িত্ব পালনসহ মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরির সময় পূর্ব তিমুরে শান্তিরক্ষা বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।