‘বলছি না আমি দুধে ধোয়া, কিন্তু সরাসরি জড়িত ছিলাম না’
‘রাজনৈতিক কারণে আমি দেশ অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতাম। বলছি না যে আমি দুধে ধোয়া। কিন্তু সরাসরি কোনো ঘটনায় আমি জড়িত ছিলাম না।’
urgentPhoto
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপিল শুনানির শেষ দিন তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করে এসব কথা বলেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
নিজামীকে উদ্ধৃত করে তাঁর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি একজন ২০ বছরের যুবক ছিলাম। এত অল্প বয়সে আলবদরের নেতা হয়ে আমি পাকিস্তান আর্মির নেতা হতে পারি না এবং সরাসরি হত্যা ও লুণ্ঠনের বিষয়ে আমার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।’
শুনানির এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, ‘আমরা আপনাদের (খন্দকার মাহবুব) প্রতিটি বক্তব্যর বিষয়ে অবগত। তবে দণ্ডবিধির ১০৭ ধারা অনুযায়ী অপরাধের সহযোগী হলেও সমান দোষে দোষী হতে হয়।’
পরে খন্দকার মাহবুব হোসেন নিজামীকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘চারটি অভিযোগে (১১, ১২, ১৩ ও ১৪) অপরাধের সহযোগী থাকায় আমাকে ট্রাইব্যুনাল খালাস দিয়েছেন। এসব অভিযোগে ছিল আমি বক্তব্য, বিবৃতি দিয়ে উসকানি দিয়েছি। কিন্তু এসব বিষয় বিশ্বাসযোগ্য ও প্রমাণিত না হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আমাকে খালাস দিয়েছেন।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আপিল বিভাগ চাইলে সবকিছু শুনতে পারি। অর্থাৎ খালাস পাওয়া চার্জগুলোর (অভিযোগ) বিষয়ে শুনতে পারব।’
এর উত্তরে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বিচারকরা অন্ধ। তাঁরা কোনো কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া বিশ্লেষণ করতে পারেন না।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা বিচারের ক্ষেত্রে অন্ধ, কিন্তু এখানে আমরা বিচারকরা কিন্তু অন্ধ নই।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘নিজামী সরাসরি জড়িত ছিলেন বা উসকানি দিয়েছেন, এ ধরনের তথ্য-প্রমাণ কোথায়? রাষ্ট্রপক্ষ তো তা দিতে পারেনি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা তা দেখছি।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘ইউটিউবে প্রসিকিউশনের ১৪তম সাক্ষী বলেছেন, জ্বালানো-পোড়ানোর ঘটনায় নিজামী জড়িত ছিলেন না। আমরা সে ভিডিওটি আপনার কাছে জমা দিয়েছি।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা এসব তথ্য আদালতে হলফনামা আকারে জমা দেন।’
জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘এসব নথির ফটোকপি হলফনামা আকারে ট্রাইব্যুনালে দিয়েছিলাম। আপিল বিভাগেও গতকাল মূলকপি জমা দিয়েছি।’
উত্তরে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনাদের এসব নথি আমরা দেখব।’
ওই সময় খন্দকার মাহবুব জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘পাকিস্তান আর্মি কর্তৃক গ্রামের পর গ্রাম জ্বলেছে। কিন্তু আমি জড়িত ছিলাম এমন কোনো তথ্য-নথি প্রসিকিউশন দিতে পারেনি। তাহলে আমার অপরাধ কোথায়?’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনাদের আর কোনো কিছু থাকলে বলেন।’
খন্দকার মাহবুব নিজামীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, ‘পাকিস্তানি আর্মিরা, ১৯৫ জনের মধ্যে যারা সরাসরি হত্যায় অংশ নিয়েছে, তাদের বিচার হচ্ছে না। অথচ রাজনৈতিক কারণে আমি সমর্থন করেছিলাম।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল আইনে সহযোগীদেরও বিচার ও শাস্তি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে।’
ওই সময় খন্দকার মাহবুব নিজামীকে উদ্ধৃত করে বলেন, ‘আমি ২০ বছরের একজন যুবক ছিলাম। মূল আসামিদের বাদ দিয়ে সহযোগী হওয়ায় দণ্ডবিধি অনুযায়ী আমাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া যায় না। ’
খন্দকার মাহবুব আরো বলেন, ‘দুজন সাক্ষী বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সাক্ষ্যতে অসামঞ্জস্য রয়েছে। বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীমের স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী দুটি বই লিখেছেন। এসব বইয়ে নিজামী উসকানি বা জড়িত ছিলেন, এমন কোনো কিছু তিনি লেখেননি। একইভাবে বুদ্ধিজীবী আজহারুল ইসলামের স্ত্রীও শাহরিয়ার কবিরের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি নিজামী জড়িত থাকার বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁরা দুজনে নিজামী উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন বলে আদালতকে জানান। এতে করে তাঁদের দুজনের বক্তব্যে অসামঞ্জস্যতা পাওয়া যায়।’
প্রধান বিচারপতি নিজামীর আইনজীবীদের উদ্দশে বলেন, ‘একাত্তর সালে জামায়াতের এবং তাদের নেতাদের কর্মকাণ্ড দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত হয়েছে।’
এ সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘তখন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। আর নিজামী ওই দলের কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছেন।’
নিজামীকে উদ্ধৃত করে তাঁর আইনজীবী বলেন, ‘আমি (নিজামী) দুধে ধোয়া নই। যা করেছে পাকিস্তানিরা। আমি ছিলাম ২০ বছরের এক যুবক। আমার কথা কি পাকিস্তানি আর্মিরা মানবে?’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য হলো যেহেতু সরাসরি তিনি জড়িত নন, তাই তাঁকে যেন খালাস দেওয়া হয়। তার পরও আদালত যদি মনে করেন প্রসিকিউশনের কোনো অভিযোগ আমলে নেবেন, তাহলে তাঁকে যেন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া না হয়।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনাদের আর নতুন কোনো বক্তব্য না থাকলে আমরা শেষ করতে পারি। ভালোভাবে মামলার নথি উপস্থাপনের জন্য আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আপনারা এ মামলা অনেক ধৈর্যসহকারে শুনেছেন, তাই আপনাদেরও ধন্যবাদ।’
শুনানি শেষে আগামী ৬ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বেঞ্চ।
গত ২ ডিসেম্বর নিজামীর পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন আইনজীবীরা। যুক্তিতর্ক শেষে তাঁরা নিজামীর বয়স এবং শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে শাস্তি কমানোর আবেদন জানান।
মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এর বিরুদ্ধে আপিল করেন মতিউর রহমান নিজামী। এর পর একই বছর ২৩ নভেম্বর ১৬৮টি যুক্তি দেখিয়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেন নিজামীর আইনজীবীরা।
এর আগে ২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই বছরের ২ আগস্ট তাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করেন ট্রাইব্যুনাল। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উসকানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। আটটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর মোট চারটি অভিযোগে তাঁকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায়ও নিজামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।