ফ্যাক্টচেক
ফাইজারের টিকার কারণে মৃত্যুর কোনো প্রমাণ নেই
উদ্যোক্তা ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ পরিচয় দেওয়া স্টিভ কিরশ নামের যুক্তরাষ্ট্রের এক ব্যক্তি দাবি করেছেন, ফাইজারের তৈরি কোভিড-১৯ টিকা যত না মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টু্ইটারসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে এই দাবি বেশ ছড়িয়ে পড়ে।
দাবিটি আসলে সঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্টার ইনস্টিটিউটের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ‘পলিটিফ্যাক্ট’ এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) এক জনমত সভায় স্টিভ কিরশ একটি প্রেজেন্টেশন দেন। তার তিন দিন আগে স্লাইড শো আকারে ওই প্রেজেন্টেশনটি তিনি টুইটারে পোস্ট করেন। বুস্টার ডোজ হিসেবে ফাইজারের কোভিড-১৯ টিকার অনুমোদন দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে আলোচনার জন্য সভাটির আয়োজন করে এফডিএ’র ভ্যাকসিন অ্যান্ড রিলেটেড বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যাডভাইজরি কমিটি।
ফাইজারের কোভিড-১৯ টিকাই যুক্তরাষ্ট্রে একমাত্র পূর্ণাঙ্গ অনুমোদনপ্রাপ্ত টিকা। এ ছাড়া জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনের ভিত্তিতে মডার্না এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার প্রয়োগ চলছে। সব বয়সীদের জন্য বুস্টার ডোজের অনুমোদন না দিয়ে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের এবং যারা গুরুতর রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য অনুমোদনের সুপারিশ করে ওই কমিটি।
ফাইজারের টিকা নিয়ে যে দাবি করা হচ্ছে
প্রেজেন্টেশনে কিরশ কোভিড-১৯ টিকার ‘ভয়াবহতা’ নিয়ে অনেকগুলো অভিযোগ তোলেন। ফাইজারের টিকার বিষয়ে তিনি দাবি করেন, ছয় মাসের এক গবেষণায় দেখা গেছে—টিকাটি যত জনকে কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে সাহায্য করেছে, সেই এক জনের বিপরীতে ‘পাঁচ জনকে মরতে হয়েছে’। এফডিএ’র জনমত শুনানির সময় অবশ্য ওই ব্যক্তি বলেন, গবেষণার তথ্য-পরিসংখ্যান তত্ত্বের বিবেচনায় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে, তথ্যগুলো সমস্যা তৈরি করেই যাচ্ছে।
স্টিভ কিরশ যে গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে মৃত্যুর এমন দাবি করা হয়নি। পিয়ার রিভিউবিহীন গবেষণাটি ছাপার আগেই ২৮ জুলাই অনলাইনে পোস্ট করা হয়। সেখানে বরং বলা হয়েছে, ‘প্রায় ছয় মাসের ফলো-আপ অনুযায়ী, ফাইজারের টিকাটি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ব্যাপক কার্যকারিতা সম্পন্ন। এবং যথেষ্ট সুরক্ষা সৃষ্টির সক্ষমতা রয়েছে এই টিকার। তবে, টিকাটি নেওয়ার পর আস্তে আস্তে কার্যকারিতা কমতির দিকে যায়।’
স্টিভ কিরশকে ফাইজারের টিকা নিয়ে দেওয়া নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার অনুরোধ জানায় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান পলিটিফ্যাক্ট। জবাবে কিরশ বলেন, ‘এসব মৃত্যু সম্পর্কিত আমার বক্তব্য শুধু ফাইজারের টিকা নিয়ে করা গবেষণার ওপর ভিত্তি করে নয়।’ আরও বেশকিছু নথির কথা তিনি বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) ও এফডিএ—এই দুটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত ভ্যাকসিন ইভেন্ট রিপোর্টিং সিস্টেম (ভিএইআরএস) ব্যবহার করেছেন বলে দাবি করেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্টিভ কিরশের দাবি—অতিরিক্ত মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হতে তিনি শুধু ভিএইআরএসসহ আটটি পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। কিরশ পলিটিফ্যাক্টকে বলেন, ;অবশেষে এটাই পেয়েছি যে, অতিরিক্ত মৃত্যুর নেপথ্যের একমাত্র নির্ভরযোগ্য কারণ টিকা।’
ভিএইআরএস ও টিকাপরবর্তী মৃত্যু
যদিও টিকাসংশ্লিষ্ট পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রবণতাগুলো বুঝতে গবেষকদের জন্য এই ভিএইআরএস ডাটাবেজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু, সিডিসি ভিএইআরএস ওয়েবসাইটে পরিষ্কার বলে দিয়েছে যে, সেখানকার তথ্যের ভিত্তিতে কোভিড-১৯ টিকার কারণে মৃত্যুর হিসাব নির্ণয় করা যাবে না।
কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার পর কোনো মৃত্যু হলেই তা ভিএইআরএসে লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধ্যকতা দিয়ে রেখেছে এফডিএ—এমনকি যদি টিকা সেই মৃত্যুর নেপথ্যের কারণ নাও হয়। শুধু তাই নয়, যে কেউ এখানে রিপোর্ট জমা দিতে পারে। ব্যাপকভাবে সহজগম্য একটি ওয়েবসাইট এই ভিএইআরএস। একই সঙ্গেবিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর উৎসক্ষেত্র হিসেবেও জনপ্রিয় এই ভিএইআরএস।
২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময় থেকে এ বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ৩৮ কোটি ৬০ লাখ ডোজেরও বেশি টিকা দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে ভিএইআরএসে সাত হাজার ৮৯৯ জনের রিপোর্ট পাওয়া গেছে, যারা কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার পর মারা গেছেন। গড় হিসাবে যা দাঁড়ায় ০.০০২০ শতাংশ।
কিন্তু, ভিএইআরএসের সব রিপোর্ট বিশ্লেষণকারী সিডিসি জোর দিয়ে বলছে—মৃত্যুসনদ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং মেডিকেল রেকর্ডসহ প্রাপ্ত ক্লিনিক্যাল তথ্যের পর্যবেক্ষণ করে কোভিড-১৯ টিকার কারণেই মৃত্যু হয়েছে, এমনটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে সিডিসির ভাষ্য, সাম্প্রতিক রিপোর্টে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে, জনসন ও জনসনের টিকা এবং কম প্লাটিলেটসহ রক্তজমাট বাঁধার (টিটিএস) বিরল অবস্থার মধ্যে ‘সম্ভাব্য সম্পর্ক’ বিদ্যমান। এর কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, সিডিসির ওয়েবসাইটে ভিএইআরএসের তথ্য সার্চ করতে গেলে ইউজারকে একটি বিষয়ে সম্মতি দিতে হয়। সেখানে বলতে হয়, ‘টিকা নেওয়ার কারণে অসুস্থতা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে অথবা টিকার প্রভাবে এমনটি হয়েছে, শুধু ভিএইআরএস রিপোর্টগুলোর ভিত্তিতে তা বলার সুযোগ নেই।’
তা ছাড়া স্টিভ কিরশ যে প্রেজেন্টেশন এফডিএ’র কমিটির সভায় উপস্থাপন করেছেন, তাতে একটি বিকল্প ওয়েবসাইট উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ইউজারদের কোনোকিছুতে সম্মতি দিতে হয় না। অর্থাৎ সাইটটিতে কোনো ডিসক্লেইমার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের টিকাবিরোধী গোষ্ঠী ‘ন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনফরমেশন সেন্টার’ সাইটটি চালায়।
গত ৪ এপ্রিল থেকে শুরু করে ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৩টি ধাপে টিকার কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করেছে সিডিসি। মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকা এই সিডিসি বলেছে, করোনার ডেলটা ভ্যারিয়্যান্ট আধিপত্য বিস্তারের পরে পূর্ণাঙ্গ ডোজ টিকাপ্রাপ্তদের চেয়ে টিকা না নেওয়া লোকজনের পাঁচগুণ বেশি সংক্রমণ এবং ১০ গুণ বেশি হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।
তাই, ফাইজারের তৈরি কোভিড-১৯ টিকার কারণে মৃত্যু হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। প্রাপ্ত তথ্য বরং উল্টোটা বলছে—কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ বা মৃত্যু ঠেকাতে টিকাগুলো বেশ ফলদায়ক।