দুই লাখে কিডনি কিনে ১৫ থেকে ২০ লাখে বিক্রি
দুই লাখ টাকায় ডোনারের কাছ থেকে কিডনি কিনে তা ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় বিক্রির অভিযোগ উঠেছে একটি চক্রের বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই চক্রটি অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচা করত বলে জানা গেছে। এ জন্য টার্গেট করা হতো গরিব ও অসহায় মানুষকে।
এ ঘটনায় কয়েকজন ভুক্তভোগী দেশের বিভিন্ন থানায় প্রতারণা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে মামলা করেন। এসব মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কিডনি কেনাবেচা চক্রের ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন ও অন্যতম মূল হোতা মো. শাহরিয়ার ইমরানসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গতকাল সোমবার রাত থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত র্যাব-৫, র্যাব-২ ও র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা যৌথ অভিযান চালিয়ে জয়পুরহাট ও রাজধানীর নর্দা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে। আজ দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিএসইসি ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা হলেন মো. শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ (৩৬), মো. মেহেদী হাসান (২৪), মো. সাইফুল ইসলাম (২৮), মো. আব্দুল মান্নান (৪৫) ও মো. তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু (৩৮)।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শাহরিয়ার দুটি ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন। একটির নাম ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার পেশেন্ট চিকিৎসা সেবা’ এবং অপরটি ‘কিডনি লিভার চিকিৎসা সেবা’। এসব পেজ থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষদের চিহ্নিত করে তাদের অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করা হতো। এরপর ডোনারকে পাশের দেশ ভারতে পাঠানো হতো।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘চক্রটি প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য রোগীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতো। কিন্তু কিডনির ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দিতো দুই লাখ টাকা। এ চক্রটি এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষকে কিডনি বিক্রির জন্য ভারতে পাচার করেছে।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অভিযানে ভুক্তভোগী কিডনিদাতাদের চারটি পাসপোর্ট, মেডিকেল চিকিৎসার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা সম্পর্কিত বেশকিছু কাগজপত্র, পাঁচটি মোবাইল ও দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘প্রতারণার মাধ্যমে কিডনিসহ মানবদেহের নানা অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে পড়ে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ প্রতারিত হচ্ছে।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের পরিচালক বলেন, ‘তাদের চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি কেনাবেচা করে থাকে। চক্রটির প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ চালায়। আর চক্রের দ্বিতীয় দলটি চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।’
‘অপরদিকে, তৃতীয় গ্রুপটি প্রলোভনের শিকার কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ডোনারকে পাশের দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এরপর ভারতে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র কিডনির ডোনারকে এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কর্মকাণ্ড করে থাকে। তারপর ভুক্তভোগীদের বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।’
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা এভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিতো। বিপরীতে তারা কিডনির ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে আশ্বস্ত করে অগ্রিম দুই লাখ টাকা দিতো।’
আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য চক্রটি কোনো প্রকার রিসিট, পাসপোর্ট বা অন্যান্য প্রমাণ ডোনারকে সরবরাহ করতো না বলে জানায় র্যাব। এ ছাড়া প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে কিডনিদাতাদের ভয়ভীতি দেখানো হতো। চক্রের হোতা ইমরান প্রতি কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন বাবদ পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা, মান্নান ও তাজুল প্রতি কিডনিদাতা সংগ্রহ বাবদ যথাক্রমে পাঁচ ও তিন লাখ টাকা নিতো বলে জানিয়েছে র্যাব।
অপরদিকে, চক্রের মূলহোতা ও অন্যতম আসামি শাহরিয়ার ইমরান ভারতে অবস্থান করে স্থানীয় দালাল ও অনলাইনের মাধ্যমে কিডনি রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন জানিয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কিডনি বিক্রির জন্য শতাধিক মানুষকে ভারতে পাচার করেছে এ চক্রটি। তাদের বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া ভুক্তভোগীরাও তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় মামলা করেছেন।’