১৩৩ টাকায় পুলিশে চাকরি, অশ্রুসিক্ত ৪০ সদস্য
ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের পদ্মার চরের সালেপুর মধ্যে এলাকার বাসিন্দা রাশেদ মোল্যা। তিনি পেশায় একজন ঘোড়ার গাড়িচালক। চর এলাকায় ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে কোনোমতে সংসার চলে তার। এমন নিদারুণ কষ্টের মধ্যে তার ছেলে সুলতানকে পড়াশোনা করিয়েছেন তিনি।
বাবা ছাড়া পরিবারে উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। চাকরির খুব প্রয়োজন ইকবালের। কিন্তু ঘুষ ছাড়া কোথায় চাকরি হবে? এমন চিন্তা মাথা থেকে দূর হচ্ছিল না তার। বাবার অজান্তে তার স্বপ্নের পুলিশ হওয়া পরীক্ষায় অংশ নেন আবেদন ফরম তিন টাকা, ব্যাংক ড্রাফট ১০০ টাকা ও অনলাইন চার্জ ৩০ টাকা মোট ১৩৩ টাকা খরচ করেন। এরপর সব ধাপ পেরিয়ে তিনি এখন একটি গল্পের নাম। হয়েছেন পুলিশের এই পরীক্ষায় ৪০ জনের মধ্যে প্রথম। কৃতজ্ঞচিত্তে বার বার স্মরণ করছিলেন ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামানের কথা। তার মতো এমন মানুষের কারণে তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
একইভাবে পুলিশের চূড়ান্ত নিয়োগ পরীক্ষায় ১৩তম স্থান হয়েছে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার শেখর ইউনিয়নের চটামখোলা কুমার পাড়ার কুমারের কাজ করা সুবোধ পালের ছেলে সুব্রত পালের। অনেক কষ্টে পড়াশোনা করে তিনি অনেকটা স্বপ্নের মতো সুযোগ পেয়েছেন পুলিশে। কোনদিন ভাবেন নাই ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারের সুব্রত কোনো রকম টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হবে। পুলিশে চাকরি পেয়ে তিনি এখন পরিবারের হাল ধরবেন এটাই এখন তার স্বপ্ন।
একই উপজেলার চতুল ইউনিয়নের বাইখির গ্রামের ইকবাল সেখ। তার বাবা পেশায় একজন দিনমজুর। কোনোমতে তার সংসার চলে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে সন্তান পুলিশে সুযোগ পাওয়ায় এখন পুরো পরিবারে খুশির ঝিলিক। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে এতদূর এসে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয় টিউশনি করে। আজ তার সেই কষ্ট ঘোচানোর দিন। কেননা পুলিশ কনস্টেবল পদে চূড়ান্ত নিয়োগ তালিকায় এসেছে ইকবালের নাম। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চূড়ান্ত ফলাফলে ঘোষণার নিজের নামটি শোনার পর চোখ অশ্রুতে ভরে যায় ইকবাল ও তার বাবা ইকরামের।
তাদের মতোই মোট ৪০ জন ফরিদপুরে শুধুমাত্র মেধা ও যোগ্যতায় মাত্র ১৩৩ টাকায় পুলিশে চাকরি পেয়েছেন। যাদের কারো বাবা কৃষক, কারো বাবা দিনমজুর-শ্রমিক, কারো বাবা রিকশাচালক, কেউবা আবার নিজেরাই গার্মেন্টসকর্মী।
জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে এবার ১৬০০ জন পরীক্ষার্থী শারীরিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে এ পরীক্ষায় ৩৪৮ জন উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়। পরে লিখিত পরীক্ষায় পাস করে ৭৯ জন। সেখান থেকে চূড়ান্ত তালিকায় নাম এসেছে ৪০ জনের। এর ভেতর চারজন নারী রয়েছেন। এছাড়াও অপেক্ষমান রয়েছে সাধারণ কোঠায় ১২ জন ও পোষ্য কোঠায় তিনজন।
ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, ‘আমি অভিভূত এবং নিজেকে গর্বিত মনে করছি ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে। আইজিপি স্যারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও চেষ্টার কারণেই শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক এ নিয়োগ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমবারের মতো প্রার্থীদের অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে তারা চূড়ান্ত তালিকায় আসতে পেরেছে।’
পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে নিয়োগ পরীক্ষার আগে থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সতর্ক ছিলাম। দালালরা যাতে প্রার্থীদের প্রতারিত করতে না পারে, সেজন্য পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা যে পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ দিলাম তারা ২০৪১ এর উন্নত বাংলাদেশের পুলিশ হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে পারবে।’