সড়ক-রেল-নৌপথে গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস কার্যকরের দাবি
দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে সব শ্রেণির গণপরিবহণে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ প্রদানের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। একই সঙ্গে যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের হাত থেকে মুক্তি দিতে সব পথে সরকার-নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আজ শনিবার সকালে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এ দাবি জানান।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন আন্দোলনের পর প্রথমে সড়ক পরিবহণমন্ত্রী সারা দেশের বিআরটিসি’র বাসে এবং পরে বাস মালিক সমিতি ঢাকা মহানগরীতে ১ ডিসেম্বর থেকে শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও এখনও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। রাজধানীর অনেক বাসে শিক্ষার্থীদের ওঠানো হচ্ছে না। অনেক বাসে অর্ধেক ভাড়া নেয় না। শিক্ষার্থীরা হাফ ভাড়া দিলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীকে বাস থেকে নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে। এতে করে যেকোনো সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে বলে অভিযোগ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব শিক্ষার্থীসহ সব যাত্রীর সসম্মানে গণপরিবহণে যাতায়াতের সুযোগ নিশ্চিত করা দাবি জানান।
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও বলেন, ‘পরিবহণ সেক্টরে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সড়কে এমন অব্যবস্থাপনার জন্য তাঁরাই দায়ী। এ খাতের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য বর্তমানে নেতৃত্বদানকারী পরিবহণ মালিক-শ্রমিক নেতৃত্বের পরিবর্তন জরুরি। এ নেতারা সরকারের সঙ্গে থেকে পরিবহণ ধর্মঘটের নামে জনগণকে জিম্মি করে সরকারের কাছ থেকে নানাভাবে ফায়দা লুটছেন। তাঁরা রাজধানীর বাসে বার বার ঘোষণা দিয়েও সিটিং সার্ভিসের ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ না করে এসব গাড়িতে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তিন থেকে চারগুণ বাড়তি ভাড়া আদায় করে নগর জীবন বিষিয়ে তুলেছেন।’
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব দেশের সব পথে সব শ্রেণির গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়া কার্যকর করার দাবি জানান।
এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০ দফা সুপারিশ পেশ করে।
২০ দফা সুপারিশ
১. সারা দেশের দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে সব শ্রেণির গণপরিবহণে একজন শিক্ষার্থী তার ছাত্রজীবনে সার্বক্ষণিক এবং যেকোনো দিন, যেকোনো সময়ে আইডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে দেশের সব শ্রেণির গণপরিবহণে হাফ পাস সুবিধা নিয়ে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দিতে হবে।
২. ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবহণে অস্বীকৃতি জানালে, হাফ ভাড়া না নিলে, সংশ্লিষ্ট পরিবহণের চালক, সহকারী, কাউন্টারম্যান, টিকিট বিক্রয়কারীর কী শাস্তি হবে তা স্পষ্ট করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা জারি করতে হবে।
৩. সব শ্রেণির গণপরিবহণ দৈনিক চুক্তিতে ইজারা দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণের শর্তানুযায়ী মালিক শুধু মুনাফা পাবে, এটি নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সব শ্রেণির গণপরিবহণে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা স্পষ্ট আকারে, দৃশ্যমান স্থানে, যাত্রীসাধারণ যাতে সহজে পড়তে পারেন, সে অনুযায়ী টাঙাতে হবে।
৫. সব পথের গণপরিবহণে মালিকদের ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় বন্ধ করে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া আদায় নিশ্চিত করতে হবে।
৬. নারী যাত্রীদের কটূক্তি এবং যৌন হয়রানিমুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে গণপরিবহণে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৭. সরকারি তালিকার অতিরিক্ত ভাড়া প্রদানের অস্বীকৃতি জানালে যাত্রীদের কটূক্তি করা, অপমান-অপদস্ত করা, নামার সময় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
৮. অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধের অভিযানে অভিযুক্ত বাসের মালিক-চালক-সহকারীর পাশাপাশি কোম্পানির এমডি-চেয়ারম্যানকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৯. গণপরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
১০. মালিক সমিতির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিটিং সার্ভিসের নামে ভাড়া ডাকাতি বন্ধে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করতে হবে। যাত্রীর মাথা গুনে গুনে স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতকারীর ক্ষেত্রে পুরো পথের ভাড়া আদায় বন্ধ করতে হবে।
১১. সিটি সার্ভিস ও শহরতলীর বাসের ভাড়া নির্ধারণে ৭০ শতাংশ গড় বোঝাই ধরে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই বাকি ৩০ শতাংশ আসনে শিক্ষার্থী, প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ব্যক্তি এবং দাঁড়ানো যাত্রীদের অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ দিতে হবে।
১২. ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকার ডিজেলচালিত বাস মিনিবাসের ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু, দেশব্যাপী চলাচলরত সিএনজিচালিত হিউম্যান হলার, লেগুনা, বাস-মিনিবাসের ভাড়া নৈরাজ্য চলছে। এসব যানবাহনে সরকারিভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে ভাড়া নৈরাজ্য থেকে মুক্তি দিতে হবে।
১৩. বাসে ওঠা-নামায় সর্বনিম্ন ভাড়া পাঁচ টাকা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরীর জন্য আলাদা আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে।
১৪. বর্তমান সরকারের গত এক যুগের ধারাবাহিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে দেশের সড়ক-মহাসড়কে গতি বেড়েছে, বহু মহাসড়কে দূরত্ব কমেছে তাই দুরপাল্লার রুটে যাত্রী প্রতিনিধি সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি রুটে দূরত্ব জালিয়াতি এবং কিলোমিটার চুরি বন্ধ করে ভাড়ার তালিকা সংশোধন করতে হবে।
১৫. গণপরিবহণে চাঁদাবাজি ও পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
১৬. কথায় কথায় যেকোনো ঠুনকো অজুহাতে গণপরিবহণ বন্ধ করে দিয়ে যাত্রীদের জিম্মি করার মতো বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
১৭. যাত্রীর নিরাপত্তায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন এবং লাইসেন্সবিহিন চালক উচ্ছেদ করতে হবে।
১৮. সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২০ লাখ টাকা, আহত ভিকটিমকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
১৯. গণপরিবহণের ভাড়া নির্ধারণে সরকার ও মালিকদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি বাতিল করে বাস ও লঞ্চের ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে যাত্রী প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
২০. নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না, সংগঠনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শরীফুজ্জামান শরীফ, সহ-সভাপতি তাওহিদুল হক লিটন প্রমুখ।