নকল সিনেমার জন্য দায়ী চিত্রনাট্যকার : ফেরদৌস
হালের চলচ্চিত্রে নকলের হিড়িক পড়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রগুলোর অধিকাংশের গল্পই ভারতীয় সিনেমা থেকে হুবহু নকল করা, কখনো আবার ভীষণ দৃষ্টিকটুভাবে দৃশ্য কেটে এনে সংযোজনের অভিযোগও উঠছে। ঐতিহ্য হারিয়ে বাংলা চলচ্চিত্র এখন ধুঁকছে, হারাচ্ছে দর্শক, প্রেক্ষাগৃহ-ব্যবসাও ধ্বংসের পথে। আর এর দায় বর্তায় নকল চলচ্চিত্রের ওপর।
তিনবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদের মতে, নকল চলচ্চিত্রের জন্য সম্পূর্ণ দায়ভার চিত্রনাট্যকারদের।
সম্প্রতি এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক আড্ডায় ফেরদৌস বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্রের বিষফোঁড়া হলো নকল চিত্রনাট্য। এঁরা ভারতীয় চিত্রনাট্যকে পরিচালকদের কাছে এমনভাবে উপস্থাপন করে যে মনে হবে বুঝি মৌলিক গল্পই বলছেন। পরিচালকরাও চিত্রনাট্যকারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। কিন্তু চলচ্চিত্রটি প্রেক্ষাগৃহে আসার পরই দর্শক বুঝে ফেলে এটা আসলে নকল সিনেমা। দর্শককে বোকা ভাবার তো কোনো কারণ নেই। ইন্টারনেটের যুগে কোন সিনেমা মৌলিক আর কোনটি নকল তা দর্শক সহজেই ধরে ফেলেন।’
ফেরদৌস আরো বললেন, ‘এক হুমায়ূন আহমেদকেই দেখেছি মৌলিক গল্পনির্ভর সিনেমা বানাতে। তারপর বেশ কয়েকজন পরিচালকও মৌলিক গল্প নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনের অনেক পরিচালক মেধাবিহীন চিত্রনাট্যকারদের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। এসব চিত্রনাট্য ভীষণ কুরুচিপূর্ণ। এমন সব চিত্রনাট্যকারের কারণেই আমাদের চলচ্চিত্র ধ্বংসের মুখে।’
চলচ্চিত্রশিল্পের খ্যাতনামা প্রযোজকরা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেন ফেরদৌস। দিলীপ বিশ্বাস, আমজাদ হোসেন, হাবিবুর রহমান খানদের মতো প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকাররা এখন আর বিএফডিসিতে আসেন না বলে আফসোসের অন্ত নেই এই অভিনেতার।
ফেরদৌস বলেন, ‘এখন যে কেউ হুট করেই পরিচালক বনে যাচ্ছেন। দু-একটি নাটক বা টেলিফিল্ম বানিয়ে কেউ পরিচালক বনে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্রাঙ্গনে এখন সবাই ক্ষুদ্র স্বার্থে বিশ্বাসী। কোথায় কীভাবে লগ্নি করবেন, কোন ক্ষেত্রে কীভাবে উন্নয়ন করবেন, তা নিয়ে কেউ সত্যি ভাবছেন না।’
কথা প্রসঙ্গে ফেরদৌস বলেই ফেললেন, চলচ্চিত্রাঙ্গনের সূতিকাগার বিএফডিসির মহাপরিচালক হতে হবে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট কাউকে। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে চলচ্চিত্রাঙ্গন নিয়ে কাজ করার জন্য একজন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দরকার। আমি মনে করি, বিএফডিসির মহাপরিচালক হওয়ার মতো যথেষ্ট যোগ্যতা অনেক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরই আছে। চলচ্চিত্রকে নিয়ে আমারও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে।’
এদিকে ২৫ ডিসেম্বর মুক্তি পেতে যাচ্ছে ফেরদৌস অভিনীত ‘স্বর্গ থেকে নরক’ ছবিটি। এ সিনেমা নিয়ে আলাপকালে ফেরদৌস জানালেন, রোমান্টিক-অ্যাকশন ঘরানার ছবির চেয়ে সামাজিক বার্তাবাহী সিনেমাই বেশি টানছে তিনবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদকে।
সম্প্রতি এক আলাপে ফেরদৌস বললেন, ‘আমি নাচ-গান-অ্যাকশননির্ভর সিনেমার বিপক্ষে নই। আমি সেসব সিনেমা করব। আমি চাই বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনগণকে যেন কোনো বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়। দর্শক সিনেমা দেখতে এসে যেন বিনোদনের পাশাপাশি সমাজের নানা অসঙ্গতির সমাধানের পথও খুঁজে পায়।’
সিনেমাটি মুক্তির প্রাক্কালে ফেরদৌস জানালেন, সিনেমায় তাঁর অভিনীত ‘ইমন’ চরিত্রটির গল্প- ‘ইমন বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে হঠাৎ একদিন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে সে ভর্তি হয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রে। সেখানেই পরিচয় এই সিনেমার নায়িকা নিপুণের সঙ্গে। চিকিৎসকদের পরিচর্যায় ভালো হয়ে ফিরে আসা ইমন তার বন্ধুর সঙ্গে মিলে পরিকল্পনা করে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। সমাজকে সে মাদকমুক্ত করে ছাড়বে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।’
ফেরদৌসের মতে, ‘স্বর্গ থেকে নরক’-এর মতো সামাজিক বার্তাবাহী চলচ্চিত্র এখন খুব কমই হচ্ছে। সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও তাতে সমাধানের পথ বলা হয় না বলেই অভিযোগ তাঁর।
‘স্বর্গ থেকে নরক’ চলচ্চিত্রটিকে অফট্র্যাক ক্যাটাগরিতে ফেলতেও নারাজ তিনি। তাঁর মতে, চলচ্চিত্র পুরোদস্তুর ‘বাণিজ্যিক ঘরানার’। এ ধরনের সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে চলবে কি না এমন প্রশ্নে ফেরদৌস বলেন, “সিনেমা চলবে তার মেরিট অনুযায়ী। গল্প ভালো হলে, নির্মাণশৈলী ভালো হলে দর্শক হলে ছুটে আসবেই। তারা এখন গল্প চায়, নতুনত্ব দেখতে চায়। আর ‘স্বর্গ থেকে নরক’ তেমনই একটি ছবি।”
চলচ্চিত্রের সহ-অভিনেত্রী নিপুণকে নিয়ে ফেরদৌস বললেন, ‘নিপুণের মতো সহ-অভিনেত্রীর সঙ্গে কাজ করা সব সময়ই আনন্দের। বেশকটি ছবিতে আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছি। তার অভিনয় দক্ষতার কথা তো সবাই জানে। এ সিনেমাতেও সে দুর্দান্ত অভিনয় করেছে।’
ফেরদৌস অভিনীত আরো একটি সিনেমা ‘নয় ছয়’ ও আসছে শিগগিরই। চলচ্চিত্রটি নিয়ে আশাবাদ শোনা গেল তাঁর কণ্ঠে। ফেরদৌস জানালেন, ‘নয় ছয়’ চলচ্চিত্রেও থাকছে সামাজিক বার্তা। একজন স্বপ্ন দেখা মানুষের নিরন্তর স্বপ্নভঙ্গের গল্প, তারপর ঘুরে দাঁড়ানো আর জীবনযুদ্ধ জয়ের গল্প এঁকেছে ‘নয় ছয়’। তরুণ পরিচালক রাফায়েল আহসানকেও নিয়ে প্রশংসা তাঁর কণ্ঠে।
‘নয় ছয়’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরদৌস। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাফায়েল নতুন পরিচালক হলেও তার মধ্যে নতুন কিছুর করার প্রবণতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। পরিচালনার নতুন নতুন দিক নিয়ে সে ভাবছে। তার মতো নতুনরা আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ইতিবাচক।’
ফেরদৌস সম্প্রতি তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নুজহাত ফিল্মসের ব্যানারে শুরু করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ‘পোস্টমাস্টার একাত্তর’-এর শুটিং। মৌসুমী ছাড়াও এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন নবাগত অভি ও নিঝুম রুবিনা। পরিচালনা করছেন রাশেদ শামীম ও আবীর খান।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অন্য সিনেমা থেকে এই চলচ্চিত্রটি একেবারেই আলাদা। নতুন পরিচালকদের ব্যাপারে ফেরদৌস বলছেন, ‘আমি নতুন পরিচালকদের সঙ্গে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করতে পারি, ততটা পারি না প্রতিষ্ঠিত পরিচালকদের সঙ্গে। নতুনদের সঙ্গে আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। আমি আমার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে আমার মতো করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করব বলেই নতুন পরিচালকদের ওপর নির্ভর করছি।’
চলচ্চিত্র প্রদর্শকদের বিশেষ সিন্ডিকেটের ওপর মহাবিরক্ত ফেরদৌস বলছেন, “নতুনদের সিনেমা চলে না, প্রদর্শকরা এমন কথা তো হরহামেশাই বলছেন। আমার ‘নয় ছয়’ সিনেমাটি নিয়ে রাফায়েলকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে সে সিনেমাটি প্রদর্শন করবে। এর আগে আমি নিজের সিনেমা ‘এক কাপ চা’-এর প্রদর্শনের সময় এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে তো সিনেমা ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যাবে। নতুনরা আর সিনেমা বানাতে আসবে না। নতুন প্রযোজক আসবে না চলচ্চিত্রে।”
একই সঙ্গে ফেরদৌস মনে করছেন, এ মুহূর্তে ঢাকাই চলচ্চিত্রে যোগ্য চিত্রনাট্যকারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। হালের চলচ্চিত্রগুলোতে নকল গল্পের হিড়িকের যে অভিযোগ তাতে তিনি তাঁদেরই দায়ী করছেন। একই সঙ্গে সিনেমা হল সংস্কারে আরো গতি আনা উচিত বলেও মনে করছেন তিনি।